ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত ও উপকূলীয় এলাকার মানুষের একটি প্রশ্ন

হাসান আকবর | সোমবার , ২৭ মে, ২০২৪ at ৭:২২ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রেমাল নিয়ে চট্টগ্রামে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা উপকূলীয় এলাকার অনেক মানুষ হালকাভাবে নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা এবং তাগাদা দেওয়া হলেও অধিকাংশ মানুষ ঘর ছাড়েনি। তাদের মতে, ঘূর্ণিঝড়ের নামে বিপদ সংকেত দেওয়া হলেও ঝড় চলে যায় অন্যদিক দিয়ে। সিগন্যাল বাড়ানোর ফলে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে।

তারা বলেছেন, এতে দেশের কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস এবং সতর্কতার বিষয়টিকে আরো সুনির্দিষ্ট এবং কেন্দ্রীভূত করার পরামর্শ দিয়েছেন। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড় কোনপথে উপকূল অতিক্রম করবে তা আগে থেকে জানার সক্ষমতা বিজ্ঞানের রয়েছে। এখানে ঝড় সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে আমেরিকা কিংবা কানাডায় বসেও বিশেষজ্ঞরা ঝড়ের গতিপথ নির্দিষ্ট করে বলে দেন। পরে দেখা যায়, ঝড় ওই পথেই যায়। অথচ বহুদূর দিয়ে যাওয়া ওই ঝড়ের বিপদ সংকেত নিয়ে দেশের পুরো উপকূলীয় অঞ্চলে তোড়জোড় চলে। বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার কথা বলে প্রশাসন এবং আবহাওয়া বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, শখ করে বিপদ সংকেত দেওয়া হয় না। বঙ্গোপসাগরের গভীরে থাকা অবস্থায় ঝড়ের জন্য আগাম সংকেত দেওয়া হয়। তখন ঝড়ের যে গতিপথ থাকে তা যেকোনো সময় পাল্টাতে পারে। তাছাড়া আগাম সতর্কতা সংকেত দেওয়া না হলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় থাকে না। জানমালের ক্ষতি এড়াতেই মূলত সতর্কতা সংকেত দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের যে উদাহরণ এবং শিক্ষা তা ভুলে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের ব্যাপারে মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ১০ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত প্রদান করা হয়। মহাবিপদ সংকেত ঘোষণার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর এবং শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বন্দরের অভ্যন্তর থেকে পণ্য খালাস, দেশের শিল্প কারখানা এবং বেসরকারি আইসিডি থেকে বন্দরে পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্দরের জেটি থেকে সবগুলো জাহাজ গভীর সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দর হয়ে যায় কন্টেনার খালাসসহ সব ধরনের কার্যক্রম।

অপরদিকে ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় শত শত বিদেশযাত্রী দুর্ভোগে পড়েন। মহাবিপদ সংকেতে উপকূলীয় এলাকার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাগাদা দেওয়া হয়। কিন্তু সামান্য বৃষ্টি এবং সাগর কিছুটা উত্তাল ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের তেমন কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত না হওয়ায় গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, আনোয়ারা, বাঁশখালী কিংবা সন্দ্বীপের উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষ নিজেদের ঘরে অবস্থান করেছেন। তারা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় এখানে আসবে না। ঝড় যাবে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের উপর দিয়ে। তাই শুধু শুধু আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে কষ্ট করব কেন? স্থানীয় সাংবাদিকদের তারা বলেছেন, বিজ্ঞান এখন অনেক অ্যাডভান্স। ঝড়ের গতিপ্রকৃতি আগাম জানা যাচ্ছে। আবহাওয়া বিভাগের আধুনিকায়ন জরুরি বলে তারা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, ঝড় এই অঞ্চলে আসবে না, সেটা নিশ্চিত।

আগের বেশ কয়েকটি ঝড়ের বিপদ সংকেতের প্রসঙ্গ টেনে তারা বলেন, ২০২৩ সালের ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখার ব্যাপারেও চট্টগ্রামে ৮ নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছিল। বন্দর থেকে শুরু করে সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ঝড় কঙবাজারে সামান্য আঘাত করে মিয়ানমারের উপর দিয়ে চলে গেছে। সেটা যে ওই পথে যাবে সেটাও আগেভাগে বলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর একই বছরের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় হানুম নিয়েও চট্টগ্রামে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছিল। অথচ ওটি কঙবাজারে তাণ্ডব চালালেও চট্টগ্রামে তেমন প্রভাব পড়েনি। ১৭ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় মিধিলার সময় চট্টগ্রামে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ও ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু ঝড় আঘাত করেনি। এবারও ৯ নম্বর সংকেত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঝড় সাতক্ষীরা অঞ্চলের উপর দিয়ে পার হতে শুরু করেছে। চট্টগ্রামে বৃষ্টিও হচ্ছে না।

তারা বলেন, বিপদ সংকেত বাড়িয়ে দিলে আতংকের সৃষ্টি হয়। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় বন্দরসহ প্রশাসনকে। কিন্তু যেখানে ঝড়ের গতিপথ নিয়ে আগেভাগে জানার সুযোগ রয়েছে সেখানে বিপদ সংকেত দেওয়ার ব্যাপারে আরো সুনিশ্চিত হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি এত হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। ঝড় যেকোনো সময় গতিপথ পাল্টাতে পারে। আগাম সতর্কতা হাজার হাজার জীবন রক্ষা করা ছাড়াও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। বিপদ সংকেতকে পাত্তা না দেওয়ার খেসারত চট্টগ্রামের মানুষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দিয়েছিল। নতুন করে আর যাতে খেসারত দিতে না হয় সেজন্যই আবহাওয়া বিভাগ বিপদ সংকেত প্রদান করে। আবহাওয়া বিভাগের এই সতর্কতার প্রেক্ষিতে প্রশাসনের সমন্বিত চেষ্টার অংশ হিসেবে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা এবং আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেনজীর ও তার স্ত্রী-কন্যার আরও ১১৯টি সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধঅভিযোগ জানাতে এসে শিক্ষকদের সাথে অভিভাবক-স্থানীয়দের মারামারি, আহত ১০