ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং

চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বেহাল, কাগজের হিসাবের সাথে মিলছে না বাস্তবের চিত্র

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজেপত্রে চট্টগ্রামে ১৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৩৯১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে ১২০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হয়েছে। বাকি ১৮৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হয়েছে। এটি কাগজের হিসেব। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। গতকাল সোমবার দুপুরে নগরীর ব্যস্ততম একটি সাবস্টেশনের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী চাহিদার মাত্র অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ নেটওয়ার্ক টিকিয়ে রাখতে দিশেহারা হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহের ব্যাপারটি আমদানি নির্ভর হয়ে উঠায় পরিস্থিতি ক্রমে অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। চট্টগ্রামের দুইটি সার কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় প্রচুর গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু আমদানি কমে যাওয়ায় এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে। গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর মাঝে কেবলমাত্র শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া বাকিগুলোতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুইটি ইউনিটই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। শিকলবাহা ৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পাওয়া গেছে ৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এছাড়া শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের এক নম্বর ইউনিট বন্ধ হয়ে রয়েছে। বাকি চারটি ইউনিট থেকে পাওয়া গেছে ১৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। দোহাজারী পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ৫১ মেগাওয়াট, হাটহাজারী পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ২১ মেগাওয়াট, রিজেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১৪ মেগাওয়াট, ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১৪ মেগাওয়াট, জুলধা ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৫৫ মেগাওয়াট, আরপিসিএল থেকে ২৫ মেগাওয়াট, বারাকা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ৪৪ মেগাওয়াট, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১১ মেগাওয়াট, শিকলবাহা-বারাকা পাওয়ারপ্ল্যান্ট থেকে ১০৫ মেগাওয়াট, বারাকা কর্ণফুলী পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১০৫ মেগাওয়াট, ইউনাইটেড ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৬৮ মেগাওয়াট, আনলিমা ১১৬ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। সবমিলে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় ১৪৫৩ মেগাওয়াট। এরমধ্যে পিক-আওয়ারে চট্টগ্রামে ১২০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হয় বলে কাগজেপত্রে উল্লেখ করা হয়। বলা হয় যে, লোডশেডিং করা হয়েছে ১৮৫ মেগাওয়াট। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন বলে মন্তব্য করে একাধিক সাব-স্টেশনের প্রকৌশলীরা বলেছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। নিয়মিত বিরতি দিয়ে নিয়মিত লোডশেডিং করছি। অবস্থা খুবই নাজুক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নির্বাহী প্রকৌশলী গতকাল সোমবার দুপুরে দৈনিক আজাদীকে জানান, পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে বিপদে আছি। মাত্র ৭শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। এই বিদ্যুৎ দিয়ে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট চাহিদার মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
প্রকৌশলীরা বলেন, আমরা কোথাও বেশি লোড নেবো সেই সুযোগ নেই। যেসব সাব-স্টেশন বিদ্যুতের রেশনিং না করে লোড বাড়াবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কার্যালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় আমরা টুকটাক যে বাড়তি লোড নিতাম সেটাও পারছি না। মানুষের কষ্ট হচ্ছে।
অপরদিকে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। বিদেশ থেকে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার কথা থাকলেও কিছুটা প্রক্রিয়াগত সমস্যার কারণে বর্তমানে দৈনিক ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ায় হঠাৎ করেই সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। আমরা চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছি না। দিতেও পারছি না। চট্টগ্রামের বহুজাতিক সার কারখানা কাফকো গত ৫ অক্টোবর থেকে সার উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। বেশ আগ থেকে বন্ধ রয়েছে সিইউএফএল। এই দুইটি সার কারখানা দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস সাশ্রয় হলেও আমদানি কমে যাওয়ায় এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। বর্তমানে কাফকো এবং সিইউএফএল চালানোর অবস্থা নেই বলে মন্তব্য করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেন, সিইউএফএল অনেকদিন ধরে কারখানা চালু করার জন্য গ্যাস সরবরাহ দেয়ার আবেদন করে আসছে। কিন্তু সরকার অনুমতি না দেয়ায় তাদের গ্যাস দেয়া হচ্ছে না। বর্তমান অবস্থায় সিইউএফএল উৎপাদনে গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। শীতের প্রকোপ শুরু না হলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে না। এলএনজি আমদানি বৃদ্ধি কিংবা দেশে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব না হলে গ্যাস এবং বিদ্যুতের সংকট লেগে থাকবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদ শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন আজ
পরবর্তী নিবন্ধকিয়েভে ইরানি ড্রোন দিয়ে রুশ হামলা, টার্গেট বিদ্যুৎ অবকাঠামো