গ্রামে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না

তীব্র গরমের মাঝে লোডশেডিং কষ্ট আরো বাড়িয়েছে

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ at ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ চট্টগ্রামে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে লোডশেডিং। দিনে ১২১৩ বার লোডশেডিং হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। আর উত্তর চট্টগ্রামেও একই অবস্থা। এখানে দিনে ১৫২০ বার লোডশেডিং হচ্ছে। এখানে অনেক এলাকায় দিনে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকে না। তীব্র গরমের মাঝে বিদ্যুতের এমন অবস্থা মানুষের ভোগান্তি বহু গুণে বাড়িয়েছে।

কষ্টে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ : চন্দনাইশ প্রতিনিধি মুহাম্মদ এরশাদ জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রামে অস্বাভাবিকভাবে লোডশেডিং বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। দিনেরাতে ১২ থেকে ১৩ বার বিদ্যুৎ আসাযাওয়া করছে। তীব্র গরম শুরু হওয়ার পর গত এক সপ্তাহ ধরে এমন চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তীব্র গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিং বাড়ায় সাধারণ মানুষকে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। রাতে ঘুমাতে পারছে না সাধারণ মানুষ। গরম ও লোডশেডিংয়ে জ্বর, সর্দি, কাশি ও ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধরা। ঠিকমতো সেচ দিতে না পারায় ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে কৃষকের ধান ও সবজির ক্ষেত। জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা সমানতালে লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছেন। চাহিদার অর্ধেকের চেয়েও বেশি লোডশেডিং হচ্ছে এ অঞ্চলে। গতকাল রোববার

পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপজেলাভিত্তিক জোনাল অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলায় দোহাজারী বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের অধীনে বিদ্যুৎ গ্রাহক রয়েছেন ২০ হাজার। এর মধ্যে ছোটবড় অনেক কলকারখানাও রয়েছে। গতকাল দিনে ৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ৫ মেগাওয়াট। এছাড়া চন্দনাইশে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছেন ৭০ হাজারের বেশি। গতকাল দিনে ১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৭ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ১২ মেগাওয়াট। সাতকানিয়া উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছেন প্রায় ৭৮ হাজার। এ উপজেলায় গতকাল দিনে ১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৮ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ৯ মেগাওয়াট। একই অবস্থা লোহাগাড়া উপজেলায়ও। লোহাগাড়ায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছেন ৯৬ হাজার। গতকাল দিনে ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৯ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ১৩ মেগাওয়াট। আনোয়ারা উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৯০ হাজার। এ বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের জন্য ২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে ১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে। লোডশেডিং ছিল ১২ মেগাওয়াট। বাঁশখালী উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার। গতকাল দিনে বাঁশখালীতে ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৮ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ১২ মেগাওয়াট। বোয়ালখালীতে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা রয়েছে ৭২ হাজার। এ উপজেলায় গতকাল দিনে ১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৭ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ১১ মেগাওয়াট। কর্ণফুলী উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা রয়েছে ৩৬ হাজার। এ উপজেলায় দিনেরাতে ১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৭ থেকে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ ইউনিয়নের উত্তর কালিয়াইশ গ্রামের আবদুল মজিদ (৬৫) বলেন, রাতে যখন বিদ্যুৎ চলে যায় তখন মনে হয় বিছানার নিচ থেকে কেউ আগুনের সেঁক দিচ্ছে। রুমের ভিতর মনে হয় সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। গরম ও লোডশেডিংয়ের তীব্রতায় দিনের বেলায় বাড়িদোকান কোথাও বসা যাচ্ছে না। দিনেরাতে সমান তালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন।

চন্দনাইশের দোহাজারী পৌরসভা এলাকার হাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, ঘন ঘন বিদ্যুতের যাওয়াআসায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বৈশাখের প্রচণ্ড গরমের সাথে নিয়মিত বিদ্যুতের যাওয়াআসা চলছে। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এ অঞ্চলের ছোটবড় কলকারখানার উৎপাদনেও ধস নেমেছে। তিনি জানান, অতিরিক্ত লোডশেডিং হওয়ায় রাতে টিকমতো ঘুমাতে পারছে না কেউ। বিশেষ করে শিশুরা বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘুম ভেঙে কান্নাকাটি শুরু করছে। ফলে দিনের বেলায় এর প্রভাব পড়ছে।

চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি১ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী দীলিপ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, রোববার লোডশেডিংয়ের মাত্রা একটু বেশি ছিল। হঠাৎ করে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ একটু বেড়ে যায়, পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। যেমন ঈদের আগে পুরো এক সপ্তাহ লোডশেডিং ছিল না। ঈদের পর ১ বৈশাখের পর লোডশেডিং হলেও সহনীয় পর্যায়ে ছিল। গতকাল লোডশেডিং একটু বেশি হলেও এটা সাময়িক। আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।

বিদ্যুতের আসাযাওয়ার খেলা : রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি জগলুল হুদা জানান, তীব্র গরম। গরমের সঙ্গে যদি বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে। এতে করে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে উত্তর চট্টগ্রামের মানুষ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বারের বেশি লোডশেডিংয় হচ্ছে। এই ভোগান্তিতে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন গ্রাহকেরা।

রাঙ্গুনিয়ার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয় বেশি। উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। কয়েকটি ইউনিয়নে দিনে ১০ থেকে ১৫ বারের বেশি লোডশেডিংয়ের ঘটনা ঘটে। তবে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ৪০ ভাগের কম। তাই লোডশেডিং বেড়েছে।

জানা গেছে, উপজেলার পোমরা, বেতাগী, সরফভাটা, চন্দ্রঘোনা, পারুয়া ইউনিয়নসহ, উত্তর ও দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার সর্বত্র লোডশেডিং চরম পর্যায়ে চলে গেছে। এর মধ্যে উপজেলার চন্দ্রঘোনার বনগ্রাম এলাকায় দিনে ১০ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। পোমরা ও বেতাগী ইউনিয়নে দিনের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বার লোডশেডিং হয়। এতে ক্ষুব্ধ এসব এলাকার বাসিন্দারা। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙসহ বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীরা লোডশেডিংয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন। তাপপ্রবাহ ও পানির অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেতে ফাটল ধরেছে। লোডশেডিংয়ে সেচ পাম্পগুলো নিরবচ্ছিন্ন চালাতে না পারায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান কৃষকরা।

গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতি বছর যখন গরম বেশি পড়ে তখন লোডশেডিং বেড়ে যায়। এতে ভোগান্তি বেশি হয়। রাতে ঘুমানোর আগে বিদ্যুৎ চলে যায়, আসে রাত ২টা কিংবা এর পরে। এতে ঘুমাতে ঘুমাতে তিনটা বেজে যায়। মাঝে আরও কয়েকবার লোডশেডিং হয়। ফলে রাতে ঠিকমতো ঘুমানো যায় না। ফলে দিনে কর্মস্থলে ঠিকমতো কাজ করা যাচ্ছে না।

তারা বলেন, উপজেলায় ঘনবসতি বাড়ছে। অন্যদিকে কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড গরম পড়ছে। ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘরে টেকা মুশকিল হয়ে পড়ে।

গোচরা বাজারের ব্যবসায়ী মো. নজরুল বলেন, সকাল ১০টায় দোকান খোলার পর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছয়বার বিদ্যুৎ গেছে। আবার রাতেও ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ যায়।

চন্দ্রঘোনার বনগ্রাম এলাকার বাসিন্দা আশরাফ উদ্দিন বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা এমন কোনো সময় নেই, লোডশেডিং হচ্ছে না। এমনকি ঘুমানোর সময় থেকে রাতের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে যায় কয়েকবার। গরম এলে নানা বাহানায় লোডশেডিং বেড়ে যায়। অথচ বিল আসে আগের মাসের চেয়ে বেশি।

এদিকে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে সবচেয়ে অসহায় অবস্থা দেখা গেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে। তীব্র গরমের মাঝে লোডশেডিংয়ে রোগীদের অবস্থা কাহিল।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌহিদুল আলম বলেন, তীব্র গরমে রোগীদের অবস্থা খুব খারাপ। হাসপাতালে রোগীদের চাপ এখন বেশি। তাই লোডশেডিং হলে রোগীদের অবস্থা কাহিল হয়। তাদের জন্য জেনারেটর ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখা হচ্ছে।

রাঙ্গুনিয়া পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের এজিএম (ওঅ্যান্ডএম) বলেন, রাঙ্গুনিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ৩৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে ১৮ মেগাওয়াট। এখান থেকে আবার সাড়ে ৪ থেকে ৫ মেগাওয়াট চলে যায় ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধানাগারের রাঙ্গুনিয়া প্রজেক্টে। এতে চাহিদার তুলনায় ৪০ ভাগের কম পাচ্ছি আমরা। ফলে স্থানভেদে এক থেকে দেড় ঘণ্টা করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসব প্রতিষ্ঠান খোলা, স্কুল কেন বন্ধ থাকবে : শিক্ষামন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধগরমে লোডশেডিংয়ে কাহিল নগরবাসী