গরমে লোডশেডিংয়ে কাহিল নগরবাসী

স্থানীয় চাহিদার বেশি উৎপাদন, তবুও চট্টগ্রামে লোডশেডিং ।। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩.১ ডিগ্রি বেশি

মোরশেদ তালুকদার | সোমবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

জরুরি কাজ থাকায় সকাল পৌনে ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছি। কাজের প্রয়োজনে তীব্র গরমের মধ্যেও প্রায় চার ঘণ্টা বাইরে ছিলাম। দুপুরে বাসায় এসে দেখি বিদ্যুৎ নেই। এতে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম বাসায় এসে ফ্যানের বাতাসে একটু বিশ্রাম নেব। তা আর হলো না। অতিরিক্ত গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকা মেনে নেওয়ার মতো না। গরম ও লোডশেডিংয়ে দুটো একসঙ্গে হওয়ায় খুব করুণ অবস্থায় আছি।

অনেকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে গতকাল সন্ধ্যায় কথাগুলো বলছিলেন নগরের মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব খায়রুল ইসলাম। তার মতো শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের কণ্ঠেও ছিল একই সুর। সবার এক কথা, তীব্র গরমের মধ্যে বিদ্যুতের আসা যাওয়া বা তীব্র লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ তারা। তাদের অভিযোগ, গত কিছুদিন ধরে গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। তবে শনিবার দিবাগত রাত থেকে গতকাল রোববার দিনভর লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে বহু গুণ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল সকালে ৪০০ মেগাওয়াট ও সন্ধ্যায় ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে চট্টগ্রামে। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, গতকাল নগরে তাপমাত্রা আগের দিনের চেয়ে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। গতকাল নগরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ দশমিক ১ সেলসিয়াস বেশি রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এছাড়া সকালে বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৭৬ শতাংশ এবং সন্ধ্যায় ছিল ৮৮ শতাংশ।

ফলে এদিন গরম অনুভূতিও বেশি ছিল। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের দুটো তথ্য সাধারণ মানুষের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করে।

বিদ্যুৎ পরিস্থিতি : বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অশোক কুমার চৌধুরী আজাদীকে জানান, চট্টগ্রামে গতকাল সকালে ৮৫০ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ১ হাজার ৫০ মেগাওয়াট চাহিদা ছিল। বিপরীতে সকালে ৪০০ মেগাওয়াট ও সন্ধ্যায় ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। তিনি বলেন, উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় বিতরণে সমস্যা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের জনসংযোগ শাখার দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ১১টায় চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১ হাজার ২৫২ মেগাওয়াট। বিপরীতে চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয় ১ হাজার ৮৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ওই সময় ১৬৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। এছাড়া সন্ধ্যা ৭টায় চাহিদা ছিল ১ হাজার ৪১৩ মেগাওয়াট। বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ১ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট। অর্থাৎ এ সময়ে লোডশেডিং ছিল ১৮৬ মেগাওয়াট।

চাহিদার বিপরীতে চট্টগ্রামে সরবরাহ কম করা হলেও চট্টগ্রামে যেসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে সেখানে গতকাল স্থানীয় চাহিদার বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। যার পরিমাণ ১ হাজার ৬৬৪ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চট্টগ্রামে হলেও উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে ঢাকাকে লোডশেডিংমুক্ত রাখার অগ্রাধিকার দেওয়ায় চট্টগ্রামে লোডশেডিং হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজাদীকে বলেন।

অবশ্য চট্টগ্রামে যেসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে সেখানে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না। গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের কারণে এমনটি হচ্ছে। জানা গেছে, গতকাল রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিট থেকে ১৫০ মেগাওয়াট, কাপ্তাই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২ নম্বর ইউনিট থেকে ৩০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২১২ মেগাওয়াট, দোহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫১ মেগাওয়াট, হাটহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৩২ মেগাওয়াট, ইউনাইটেড পাওয়ার থেকে ৫ মেগাওয়াট, জুলধা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২০ মেগাওয়াট, মীরসরাই বিআর প্ল্যান্টে ১৬৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া বাঁশখালীতে অবস্থিত এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ২৬৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৫৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে।

গরমে কাহিল : পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা মো. আবদুল বারেক জানান, গতকাল নগরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নগরবাসী বলছেন, গ্রীষ্মের খরতাপের সঙ্গে অতিরিক্ত আর্দ্রতায় বেশ কিছুদিন ধরে অতিষ্ঠ আছেন চট্টগ্রামবাসী। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লোডশেডিং। তাই তাদের অবস্থা বেহাল।

গতকাল দুপুরে নগরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, গরমে হাঁসফাঁস করা পথচারীরা ছায়ার আশায় ছুটছেন এদিকসেদিক। সিআরবিতে দেখা গেছে, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ গাছের নিচে বসে আছেন। দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষেরা জানিয়েছেন, গরমের কারণে তাদের আয় কমেছে। মফিজুল ইসলাম নামে এক রিকশাচালক আজাদীকে বলেন, আগে সকালে রিকশা নিয়ে বের হলে একটানা দুইটাতিনটা পর্যন্ত চালাতাম। মাঝখানে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আবার বের হতাম। কিন্তু গরমের কারণে দিনে রিকশা চালাতে পারছি না। সকালে ৯টার আগে এক ঘণ্টা চালাই। এরপর সন্ধ্যায় আবার বের হই। পুরোদিন রিকশা চালাতে না পারায় আয় কমেছে।

নগরের ২ নং গেট এলাকার বাসিন্দা সোলাইমান আজাদীকে বলেন, বিদ্যুৎ এই আসে, এই যায়। এদিকে গরমও কমছে না। গরমে বিদ্যুৎ না থাকায় খুব কষ্টে আছি।

তাপপ্রবাহ আরো তিন দিন : গতকাল আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশের উপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ আজ (গতকাল) হতে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগ্রামে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না
পরবর্তী নিবন্ধহেলমেট ছিল না চুয়েটের ২ শিক্ষার্থীর, যার ছিল তিনি বেঁচে গেছেন