বাংলাদেশ বিমানের সুপরিসর বোয়িংয়ে বিজি-৩১৫ ফ্লাইট ছাড়ার পূর্ব মুহূর্ত। মাঝখানের রো’ র একপাশে আমি, অন্যপাশে অন্যযাত্রী। আমার পাশে এক বয়স্ক মহিলাকে বসিয়ে দিয়ে দ্রুত পেছনে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেল যুবকটি। বিমান টেকঅফ করার পর থেকেই অস্থির মহিলা। ঘণ্টা যায়, দু’ ঘণ্টা যায় যুবকের দেখা নেই। মহিলা এবার পাগলপ্রায়। “আঁর নাতি আঁরে বোয়াইদি হন্ডে গেইয়েগই” (আমার নাতি আমাকে বসিয়ে দিয়ে কোথায় চলে গেছে) বলে একটু খুঁজে দেখতে বলছে আমাকে। বললাম, পেছনেই থাকবে আপনার নাতি, নেমে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে মহিলা দ্রুত কয়েকবার উচ্চারণ করলেন বগুড়া-বগুড়া। কথা বলছিলেন রোহিঙ্গা ভাষায়। বললেন, তিন মাস আগে চিটাগাং এসে দ্রুত স্থানীয় ভাষা শিখে ফেলেছেন। বুঝলাম সব শিখানো কথা বলছেন।
‘বার্মার মংডু’ তুন এপারত আইস্যন হঁত্তে, হন ক্যাম্পত আছিলান?’ (বার্মার মংডু থেকে এই পাড়ে(বাংলাদেশে) কখন আসলেন, কোন ক্যাম্পে ছিলেন?) – ওদের ভাষায় আমার সরাসরি প্রশ্নে মহিলা মুচকি হেসে বলা শুরু করলেন। যার সারার্থ হল – তিনি আরাকান (রাখাইন) থেকে বাংলাদেশে এসেছেন মাস তিনেক আগে, সৌদী আরব যাবেন বলে। যখন গন্ডগোল শুরু হয়নি (বাস্তুচ্যুত হয়ে রোহিঙ্গাদের এখানে আসা) তার আগে আরেকবার এসেছিলেন পাসপোর্ট বানাতে। ঢাকা থেকে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশী পাসপোর্ট তখন বানিয়েছেন বগুড়ার ঠিকানায়। পাসপোর্ট নিয়ে আবার ফিরে গিয়েছিলেন। বাস্তুচ্যুত হয়ে আসেন নি। সেখানেই ছিলেন। সেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েই যাচ্ছেন সৌদী আরব। সেখানে তার নাতি হারুন এবং অন্যরা থাকে মদিনায়। হারুন দোকান করে। দীর্ঘ ভ্রমণপথে দেখলাম মহিলা একা নন। একই ফ্লাইটে আরো অন্তত ১৭ জন রোহিঙ্গা নারী- পুরুষকে দেখলাম জেদ্দায় অবতরণের পূর্বে চিল্লাচিল্লি- চেঁচামেচি করছিল, যারা আমার পাশে বসা মহিলার সাথেও এসে মাঝেমধ্যে কথা বলছিল। আমি যখন মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম এদের কথা তিনি তাদের চেনার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করছিলেন। বুঝলাম, সৌদী আরবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার আগেই তাদের ব্রিফ করে দেওয়া হয়েছে কোথায় কি বলতে হবে তা।
ঘটনাটি ২০১৮ সালের জুন মাসের। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে জেদ্দা যাওয়ার পথে এই ঘটনাটি তখনই আমাকে চিন্তায় ফেলেছিল। অনেকদিন ধরেই শুনে আসছিলাম, বিভিন্ন লেখায় পড়ছিলাম রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে দলে দলে সৌদী আরব গিয়ে নানান ধরনের অপকর্ম করছে। যার দায় এসে পড়ছে বাংলাদেশের ঘাড়ে। এরা কিন্তু শরণার্থী নয়। তারা মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের অনেক আত্মীয় স্বজন বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদী আরব গিয়ে সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যে ভাল অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। এরা একে অন্যকে সেখানে টিকে থাকতে সহায়তা করে। সৌদী আরব সরকার এসব রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অলিখিতভাবে কিছুটা উদার। ফলে রোহিঙ্গারা সেখানে বেপরোয়া। তাদের তরুণ সন্তানরা বেশ উচ্ছৃঙ্খল তা নিজের চোখে দেখেছি মক্কা, মদিনা ও জেদ্দা নগরীতে।
বাংলাদেশের ঘাড়ে এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা। এর বাইরে আরও লাখ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে নাগরিকত্ব নিয়ে আরাম – আয়েশে বসবাস করছে। এরা বিতাড়িত হয়ে আসেনি। রাখাইনে নিয়ন্ত্রিত জীবন ছেড়ে উন্নত জীবনের লক্ষ নিয়ে ওরা বাংলাদেশে এসে শুধু গেড়েই বসেনি। এখানে সামাজিকভাবে অনেকে প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন। বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে বামাইয়া পাড়া। কক্সবাজার, বান্দরবান এলাকার অনেক উপজেলায় এই বার্মাইয়া রোহিঙ্গারা উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন বা আছেন। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১১ লাখের মত। যা স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বিগুণ। চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ এমন কোন অপকর্ম নেই এরা করছে না। স্থানীয়রা তাদের অপকর্মের প্রতিবাদ করতে গেলে অপদস্থ- নিগৃহীত হচ্ছে। টেকনাফ, উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা এখন নিজ দেশে পরবাসীর মত অসহায় জীবন যাপন করছেন। কঙবাজার সদরেও ব্যবসা- বাণিজ্য এবং সন্ত্রাস- অসামাজিক কার্যকলাপসহ অনেক কিছুরই নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে ওঠা অসংখ্য কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা এদেশে নিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকেই এভাবে কোটিপতি বনে গেছেন। বাংলাদেশি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো সীমান্ত ঘেঁষে টাওয়ার বসিয়েছে। রোহিঙ্গারা এসব মোবাইল ফোনে সহজেই রাখাইনে যোগাযোগ করতে পারছে। ওপারে মংডু, আকিয়াবসহ বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরতদের হাতে অসংখ্য বাংলাদেশী সিম। যা ব্যবহৃত হচ্ছে মাদক চোরাচালান, মানব পাচারসহ নানান অপকর্মে। অবৈধ ব্যবসায় বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়া এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পেতে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে দ্বিধা করছে না। টাকার লোভে তাদের এই কাজে সহায়তা করছেন কিছু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের কতিপয় সদস্য। দুর্নীতি দমন ব্যুরো (দুদক) বেশ কিছুদিন ধরে এ নিয়ে তদন্ত কাজ চালিয়ে সমপ্রতি কয়েকটি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশি জাতীয়তা সনদ দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র পাইয়ে দেওয়ার অপকর্মে লিপ্ত থাকার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রায় ৩৫ হাজারের মত জাতীয় পরিচয়পত্র এভাবে রোহিঙ্গাদের নামে ইস্যু করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। যেসব রোহিঙ্গা উখিয়া- টেকনাফের শরণার্থী শিবির সমূহে অবস্থান করছে তাদের ডাটাবেইস করা আছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই ডাটাবেইসের কারণে এসব রোহিঙ্গারা শনাক্ত হলেও যারা আরাকান (বর্তমানে রাখাইন) থেকে এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নাগরিকত্ব সনদ সংগ্রহ করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বানিয়ে নিচ্ছে তারা থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। তদন্তের বাইরে। শুরুতেই বিমানের ফ্লাইটে দেখা হওয়া রোহিঙ্গাদের মত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, যশোর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, রংপুরসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে নাগরিকত্ব সনদ নিয়ে এদেশের পরিচয়পত্র পাওয়ার সংখ্যা নেহায়েত কম হবে না। শরণার্থীদের ডাটাবেইস থাকায় তাদের শনাক্তকরণ যত সহজে হচ্ছে এদের শনাক্ত করাটা তত সহজ হবে না। তারপরও দেশের স্বার্থে দেরি না করে কাজটি এখনই শুরু করা উচিত।
বাংলাদেশের ঘাড়ে এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝার কথা অফিসিয়ালি বলা হয়। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামের এমন কোন উপজেলা নেই যেখানে রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে না। এরা জিয়াউর রহমানের সময়কাল থেকে এখানে এসে অনেকটা জামাই আদর পেয়ে এখানের জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে মেয়ে বিয়ে দিয়ে বা ছেলের বিয়ে করিয়ে মিশে গেছে স্থানীয় সমাজে। এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার সেখানে আধুনিক সুযোগ- সুবিধাসহ সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করলেও তাদের সেখানে যেতে চরম অনীহা। কারণ সীমান্ত এলাকা ছেড়ে গেলে যে মাদক ব্যবসায় বিপুল অর্থ উপার্জনের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। অল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা সেখানে গেলেও তারা পালানোর চেষ্টা করছে প্রতিদিনই। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করে। সমপ্রতি জাতিসংঘের একটি টিম ভাসানচর পরিদর্শন করে সবকিছু দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে তাদের সফরের সময় রোহিঙ্গারা সেখানে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। তারা মাসিক ভাতাসহ অনেক দাবি দাওয়া পেশ করেছে যেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মহা ভুল করে ফেলেছে বাংলাদেশ। এখানে আশ্রয় পেয়ে এখানকার পরিবেশ প্রকৃতির বিপর্যয় ঘটিয়ে তারা আমাদের যে চরম সর্বনাশ করে চলেছে সেজন্য তাদের কোন অনুশোচনা আছে বলেও মনে হয় না।
সৌদী আরব, তুরস্কসহ যেসব মুসলিম রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিনিয়ত অশ্রুপাত করছে, বাংলাদেশকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে তারা কিন্তু কেউ বলছে না কিছু রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা। এখানে শরণার্থী শিবিরগুলোতে যেসব এনজিও কাজ করছে তারা রোহিঙ্গাদের নানাভাবে উসকানি দিচ্ছে। প্যালেস্টাইনের ভূমি দখল করে প্রতিষ্ঠিত ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলে যেমন আজ ফিলিস্তিনিরা নিজদেশে পরবাসী হয়ে আছে আমাদেরও সেরকম অবস্থায় নিয়ে গিয়ে সমস্যা দীর্ঘায়িত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগও উঠেছে অনেক এনজিওর বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গা সমস্যা যত দীর্ঘায়িত হয় এনজিওগুলোর ততই পোয়াবারো।
রোহিঙ্গাদের জন্য সৌদী আরবের পিরিতি সেই ৪০/৪২ বছর আগে থেকে। এখন সেই সৌদী আরব ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে বলছে, নাগরিকত্বহীন এসব রোহিঙ্গাকে যেন বাংলাদেশ পাসপোর্ট দেয়। এই রোহিঙ্গাদের তৎকালীন সৌদী বাদশা সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ করিডোর ব্যবহার করে বা সরাসরি আরাকান থেকে তাদের নেওয়া হয়েছিল ৩০ -৪০ বছর আগে। সেখানে বংশবৃদ্ধি হয়ে সংখ্যায় তারা বেড়েছে। তাদের সন্তানরা কখনো বাংলাদেশ আসেনি। ওরা আরবী ভাষায় কথা বলে। সৌদী সংস্কৃতিতে লালিত পালিত। গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সংবাদ সম্মেলন করে এই তথ্য দিয়ে বলেছিলেন, ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট ইস্যু করতে সৌদী আরব দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গার কোন নাগরিকত্ব নেই। সৌদী সরকার বলছে, তাদের পাসপোর্ট দিতে। তা না হলে সৌদী আরবে যে ২২ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে তাদের ব্যাপারে তারা নেতিবাচক অবস্থান নেওয়ার কথা ভাববে।
বাংলাদেশকে আর কত যন্ত্রণা সইতে হবে গোদের উপর রোহিঙ্গা নামক বিষফোঁড়ার জন্য তা অনিশ্চিত।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।