গুমাইবিল কি বাঁচবে

ইটভাটা ও দখল

রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ২০ মে, ২০২৩ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

দেশের কৃষিতে বড় অবদান রাখছে চট্টগ্রামের শস্যভাণ্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাইবিল। প্রচলিত আছে এই বিল দেশের আড়াই দিনের খাদ্যের জোগান দিতে সক্ষম। দেশের অন্যতম বৃহৎ তিন ফসলি এই বিল থেকে বছরে উৎপাদিত হয় শত কোটি টাকার বেশি মূল্যের ধান। প্রতি মৌসুমে ধান রোপণ, যত্ন নেয়া ও কাটার সময় দেশের নানা প্রান্ত থেকে শত শত শ্রমিক আসেন এই বিলের গৃহস্থদের কাছে শ্রম বিক্রি করতে। এছাড়া বিলটিতে রয়েছে নানা প্রাণী বৈচিত্র্য আর মাছ। তবে ইদানীং নানা মহলের দখল আর পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটাসহ নানা স্থাপনার কারণে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে গুমাইবিল। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করেছে সাধারণ কৃষকদের মাঝে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস জানান, রাঙ্গুনিয়ায় এবার ৮ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে গুমাইবিলে আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। যেখান থেকে গড়ে ৬ টন করে মোট ১৮ মেট্রিক টন ধান পাওয়ার আশা করছেন তিনি। প্রতি কেজি ধানের বাজারে মূল্য সরকারি হিসেবে ৩০ টাকা। ফলে উৎপাদিত ধানের বাজার মূল্য প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। এভাবে তিন ফসলি এই গুমাইবিলে বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার উপরে ধান উৎপাদিত হয় বলে তিনি জানান।

সূত্রে জানা যায়, গুমাই বিল একসময় ঝিল ছিল। ঝিলে পাওয়া যেত প্রচুর মাছ। ১৯৪৫ সালে স্থানীয় আবদুল বারী তালুকদার এই বিল সংস্কার করে আধুনিক চাষাবাদ শুরু করেন। গুমাই ঝিলকে গুমাই বিলে পরিণত করার শুরু তার হাত দিয়েই। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা, মরিয়মনগর, হোসনাবাদ, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া, লালানগর ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৭, ৮ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গুমাই বিলের অবস্থান। বিলের জমিতে প্রতি বছর ইরি ও আমনের বাম্পার ফলন হয়। পাকিস্তান আমল থেকে এই বিলে ধান চাষ শুরু হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো এখানে আধুনিক সেচের ব্যবস্থা করে। স্থানীয় বাইনালার ছড়া, সোনাইছড়ি, মুন্দরী, কুরমাই, ইছামতি, বারঘোনিয়া, ঘাগড়া হ্রদ খাল ও গুট্টাকার খালের সংযোগ রয়েছে গুমাই বিলের সঙ্গে। এর মাধ্যমে পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে কৃষি বিভাগ। শুরুতে এই বিলের আয়তন ছিল ৪ হাজার হেক্টরেরও বেশি। বর্তমানে তা কমতে কমতে ৩ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে।

সরেজমিনে চট্টগ্রাম শহর থেকে কাপ্তাই সড়কপথে প্রায় ২৮ কিলোমিটার অতিক্রম শেষে রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর চৌমুহনী পার হলেই দেখা মিলে ঐতিহ্যবাহী গুমাই বিলের। শুধু ধান কিংবা ফসল উৎপাদনই না, গুমাইবিলে রয়েছে বিচিত্র প্রাণী বৈচিত্র্য। এখানে চোখ বুলালেই নজরে পড়বে মহিষের পালের বিচরণ। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় গুমাইবিলের আকাশজুড়ে টিয়া পাখির ঝাঁক, সাদা বকের উড়াউড়ি কিংবা গুমাইবিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালে নানা প্রজাতির মাছ গ্রাম বাংলার চিরাচরিত রূপকে ফুটিয়ে তুলেছে।

গুমাইবিলের বুক ছিরে বয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি খাল থেকেই ফসলী জমিগুলোতে সেচের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া বর্ষাজুড়ে বিলে মেলে প্রচুর মাছও। আশেপাশের এলাকাগুলো থেকেও প্রচুর মানুষ গুমাইবিলে মাছ ধরতে আসে। তবে জেলেরা জানান, আগে এই বিল থেকে প্রতিদিন প্রায় সাত থেকে আট কেজি মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু বর্তমানে বিলের পরিসর কমে যাওয়ায় আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। গুমাইবিলে ধান কাটতে আসা হাকিম মিয়া নামের এক শ্রমিক বলেন, আমি প্রতিবছর এখানে নেত্রকোণা থেকে কাজ করতে আসি। গুমাই বিলে আমার আসাযাওয়া ২০ বছর। ফসলের মাঠ থেকে উঠে আসতে দেখা হয় জমির মালিক মো. ফরিদ উদ্দীনের সাথে। তিনি বলেন, এবার ৬০ কানি জমিতে বোরো ধান চাষ করেছি। গেল কয়েক বছর ধরে ধানের ভালো দাম পাওয়ায় চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। তবে বিশাল এই বিল পেরিয়ে জমির ধান নিয়ে ফেরা অনেক কষ্টের। পাড়ি দিতে হয় মাইলেরও বেশি পথ। তবে দূরত্ব বেশি হলে খরচ বাঁচাতে কেউ কেউ ট্রাকে ফসল পরিবহন করেন। আবার কেউ সেখানেই ধান ভাঙেন। তাই গুমাইবিলে সড়ক প্রশস্ত ও উন্নতকরণ, ছায়ার জন্য টিনশেড, আরও নলকূপ স্থাপনসহ সেচ ব্যবস্থা আরও সহজ ও উন্নত করতে হবে।

দিগন্ত বিস্তৃত এই গুমাইবিলের কৃষকদের মাঝে ভর করেছে দুশ্চিন্তা। মানুষের দখল আর পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটাসহ নানা স্থাপনার কারণে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে গুমাইবিল। হারাতে বসেছে তার নিজস্ব প্রাণবৈচিত্র্য। তাহলে কি প্রাণ হারাবে শস্যভাণ্ডার খ্যাত এই গুমাইবিল! কৃষকরা বলছেন গুমাইবিলের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপনের কারণে কমেছে এর আয়তন। গড়ে উঠেছে পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটা। দিনের আলোতেই কৃষি জমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে ভাটায়। রীতিমতো পুকুরের মতো করে ফেলা হয়েছে ভাটার আশেপাশের কৃষি জমি। ভাটার চিমনি দিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া। এই অবস্থায় শস্যভাণ্ডার গুমাইবিলকে দখল দূষণ থেকে রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এই ব্যাপারে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ জামশেদুল আলম বলেন, গুমাই বিল রাঙ্গুনিয়ার ঐতিহ্য। একইসাথে জাতীয় সম্পদ। যেকোনো মূল্যে গুমাই বিল রক্ষা করা সকলের দায়িত্ব। আর ফসলের আবাদ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট অনুশাসন রয়েছে। তাই সমগ্র গুমাই বিলে শ্রেণি পরিবর্তন করে কোনো স্থাপনা না করতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। একইসাথে মাইকিং করে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে উপজেলা ভূমি অফিস।

গুমাই বিল রক্ষায় প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিয়েছে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতাউল গনি ওসমানী বলেন, গুমাইবিল রক্ষায় নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। প্রশাসনের এই কঠোর অবস্থানে রাঙ্গুনিয়াবাসী সম্পৃক্ত। উপজেলার মানুষ এটাকে গুমাই বিল রক্ষার আন্দোলন হিসেবে দেখতে চায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেড়িবাঁধ ঘিরে দুশ্চিন্তা দুই লক্ষাধিক মানুষের
পরবর্তী নিবন্ধসুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে