৪ মে ২০২১ তারিখের দৈনিক আজাদীর অষ্টম পাতায় একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল-‘বিশ্বজুড়ে চট্টগ্রামের তরুণদের জয়যাত্রা’। সংবাদটির জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। এখন তারুণ্যের এমন জয়গান কেউ করে না। বছর কয়েক আগে আরেকটি দৈনিক ‘তারুণ্যের জয়গান’ উৎসবের আমন্ত্রণপত্রে লিখেছিল- ‘তুমি তরুণ! তোমার ভাবনা, মেধা আর দক্ষতায় ধরা দেয় সাফল্য। তোমার সাহসিকতা, উদ্যোগ আর উদ্যম ছিনিয়ে আনে বিজয়। তুমি হতাশ হও না। তুমি হারতে জানো না। সহিংসতা নয়, ভালোবাসাই তোমার বিজয়ের হাতিয়ার। দেশটাকে গড়তে পারো তুমিই।’
এমন বিশ্বাস শাশ্বত, আজন্ম লালিত। এ বিশ্বাসে আঘাত হয়েছে অতীতে, বর্তমানে হচ্ছে, হয়ত ভবিষ্যতেও হবে। এতে তারুণ্য কখনও কখনও বিপথগামী হয়েছে। আমরা ভুলি কি করে ৭৫ পরবর্তী হিজিবুল বাহার নামের প্রমোদতরীর কথা। এটি ছিল, মেধাবী তারুণ্যকে বিপথগামী করার প্রথম সরকারি উদ্যোগ। পচন ধরানোর চেষ্টা সেই শুরু, তারপর চলতেই আছে। বর্তমানে তা সহিংস উগ্রবাদে রূপ নিয়েছে। তারুণ্য জয়যাত্রার পরিবর্তে এখন জঙ্গিবাদের অতল গহবরে প্রবেশ করছে। এরমধ্যে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি লালন, হাসনের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে। যতীন সরকার বলেছেন, ‘লোকসংস্কৃতি হলো আমাদের শেকড়। লোকসংস্কৃতিই পারে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।’ আমরা সে পথে যাইনি। লোকসংস্কৃতিকে আধুনিকতার বেনোজলে ধুয়ে-মুছে পশ্চিমা আবরণ পড়িয়ে গ্রহণ করতে গিয়ে নতুন বিপদের মুখোমুখি হয়েছি। লোকসংস্কৃতিকে নগ্নতার আবরণে পেঁচিয়ে প্রত্যাখ্যানের সর্বনাশা পথে ঠেলে দিয়েছি। প্রিয় তরুণ, বুঝতে হবে, এই নগ্নতার অনুপ্রবেশের কাজে উগ্রবাদীদের কারসাজি আছে, যাতে এটাকে প্রত্যাখ্যান করা যায়। তরুণ, তুমি ওপথেই পা বাড়ালে! তোমাকে বলা হয়নি কিংবা ভুলে গেলে, তুমি পথ হারালে পথ হারাবে বাংলাদেশ! সহিংস উগ্রবাদ ইতিহাস, ঐতিহ্যকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে দেবে। আগেই বলেছি, ৭৫ পরবর্তীতে যার সূত্রপাত অজান্তেই আজ তা মহীরুহ। তাই অনেকে বলেন, তরুণ তুমি পথ হারিয়েছ। হারিয়ে যাওয়া পথের সন্ধান দিতে গিয়ে তাঁরাই আবার তোমাকে বিভ্রান্তির নতুন চোরা বালিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে গত দশকের গোড়ার দিকে অনেক রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিবিদ, গবেষক উগ্রবাদের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষণাকে প্রাধান্য না দিয়ে, বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে নিজেদের সনাতনী ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। অনেকে আবার কারণ অনুসন্ধানের সহজতর পথ খুঁজছিলেন। এসব আলোকিত মানুষেরা একবারও নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে খতিয়ে দেখেননি। তাঁরা একবারও বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে তারুণ্যকে কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারেননি। এনজিওসমূহ স্বল্পসময়ের জন্য এ দায়িত্বভার নিলেও পুরো বিষয়টা মধ্যবিত্তের চাদরে ঢাকতে গিয়ে সফল হয়নি।
তরুণ! মনে রাখবে, আজকের উগ্রবাদ যাকিনা উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে থমকে দিচ্ছে, বিশ্বময় সন্ত্রাসবাদরূপে তা বিস্তৃতি লাভ করে নাইন ইলেভেনের মাধ্যমে। হে তরুণ, সেদিন যারা ‘বাংলা হবে আফগান’ স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করেছিল, তাদের কি হোলি আর্টিজানে কোনো ভূমিকা নেই? শোলাকিয়ায় তাদের পদধ্বনি কি শুনতে পাওনি? তাদের কি কোনো অংশগ্রহণ নেই সাম্প্রতিক ব্রাক্ষণবাড়িয়া, হাটাজারি, নারায়ণগঞ্জ এবং ২০১৩ সালের শাপলাচত্বরের ঘটনাপ্রবাহে? তরুণ তোমাকেই বলছি, এ বাংলাদেশকে ওরা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, কারণ ওরা চায়নি দেশটি স্বাধীন হোক। ওরা চায় না, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তকমা ছিঁড়ে ফেলে একটি উন্নত রাষ্ট্র হোক। বিশ্বময় যারা সহিংস উগ্রবাদকে প্রশয় দিয়ে লালন করছে, ওরা পাকিস্তানে সফল হয়েছে, আফগানিস্তানে সফল হয়েছে। পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র করতে পেরেছে। পারেনি শুধু সবুজ নিলীমায় ঘেরা এই বাংলাদেশকে।
পৃথিবীর অনেক দেশে পারলেও বাংলাদেশে পারেনি কেন? প্রশ্নটি মনে করিয়ে দেই- ৫২, ৬২, ৬৯, ৭০, সর্বোপরি ৭১-এর মুক্তিসংগ্রামে তারুণ্যের বিস্ময়কর উত্থানকে। এমন একটি সম্ভাবনাময় জাতির ধমণীতে উগ্রবাদের বিষরক্ত প্রবাহিত হতে পারে না। তারপরও আমাদের অজ্ঞাতে কিংবা অবহেলায় বেনোজল ঢুকে পড়েছে! অভিমানী তরুণ তুমি, অভিমানে দিশেহারা হয়ে সেই অন্ধকারে পা বাড়ালে? তোমার তারুণ্য, অতীতে তোমার বিস্ময়কর উত্থান তোমাকে আলোর পথে, সাম্যের পথে ফেরাতে পারেনি। তোমার হিরন্ময় অতীত তোমাকে আলোর হাতছানি দিয়ে ডাকতে পারেনি। তাই ৫০ বছরের বাংলাদেশের তারুণ্য মাদক, এইডসের চেয়ে ভয়াবহ মারাত্মক ঘাতক ব্যাধি উগ্র জঙ্গিবাদের বিষ পান করে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এখন তারুণ্যকে হতাশার অমানিশা থেকে ফেরানোর স্বপ্ন কেউ দেখায় না। এখন আসলে স্বপ্ন দেখার বা স্বপ্ন দেখানোর লোকের বড়ই অভাব। তাই এখন তারুণ্য দুঃস্বপ্ন দেখে, আমরা তাদের নিয়ে হতাশায় ভুগি, আমরাও তাদের নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি। বর্তমান সময়টা হতাশা আর দুঃস্বপ্নের বেড়াজালে আটকে আছে। আমরা তারুণ্যের চোখে-মুখে স্বপ্নের জাদুর কাঠি ছোঁয়াতে পারিনি, সাম্প্রদায়িক শক্তি ঠিকই তাদের হাতে বোমা, অস্র তুলে দিতে পেরেছে। তারুণ্য, ৭৫ পরবর্তী শূন্যতার সুযোগে মধ্যযুগীয় ভাবধারার আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়েছে। তারা আত্মঘাতী মরণ খেলায় মেতে উঠেছে। এখানে বিজ্ঞান, শিল্পবিপ্লব, সাংস্কৃতিক চেতনা বিকশিত করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা কেউ পায় না। এখানে প্রত্যুষে স্বজনের হাসিমাখা মুখ দেখে কাজে বেরিয়ে সন্ধ্যায় লাশ হয়ে ঘরে ফিরে। জীবন হয়ে উঠছে বিভীষিকাময়। এখন খেলাঘর, কচিকাঁচার আসর, উদীচী, আওয়ামীশিল্পী গোষ্ঠী ইত্যাদির শাখা উদ্বোধন হয় না। জেএমপি, হরকাতুল জেহাদ উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উত্থানের খবর আসে।
প্রিয় তারুণ্য, কেন এমনটি হচ্ছে? এর অন্তর্নিহিত কারণ, হতাশা এবং নিঃসঙ্গতা। বাস্তব জীবনের চরম ব্যস্ততার মধ্যে আমরা তারুণ্যের প্রতি দায়বোধ ভুলেছি। এই ভুল করার আর ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতির ফলাফল তারুণ্যের শেকড়চ্যুতি হওয়া। অনেকে এটাকে আইনের শাসন বা সুশাসনের দোহায় দিচ্ছেন। তাহলে নিউজিল্যান্ডের হামলাকে কীভাবে দেখব? এপ্রসঙ্গে ভয়েজ অব আমেরিকাকে সিঙ্গাপুরের ইন্টারন্যাশানাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভাইওলেন্স এন্ড টেরোরিজম রিসার্স-এর অধ্যাপক রোহান গুণরত্মা বলেছেন, ‘আসলে গণতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির সঙ্গে সন্ত্রাসের কোনো সম্পর্ক নেই। সন্ত্রাসবাদ গণতান্ত্রিক এবং অগণতান্ত্রিক উভয় সমাজেই দেখা গেছে। যেমন উত্তর গোলার্ধের অনেক দেশেই গণতন্ত্র আছে, অথচ সেখানকারও কোন কোন দেশে আমরা সন্ত্রাস লক্ষ্য করেছি, যেমন লক্ষ করেছি দক্ষিণ গোলার্ধ বা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে।’ পলিমাটির দেশের মানুষ হিসাবে জাতিগতভাবে আমরা আবেগপ্রবণ। তারুণ্যের কাঁচা আবেগকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাঙালির যৌথ জীবনের পারিবারিক বন্ধনকে স্মরণে আনব। বাঙালির যৌথ পরিবারের চিরায়ত সংস্কৃতি এখন বিলুপ্ত প্রায়। যৌথসত্তাকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি আধুনিকতার নামে। তারুণ্যের নিসঙ্গতা, স্বার্থপরতার সূত্রপাত এখানেই। তারুণ্য তুমি হিরোইজম, এডভেঞ্চার ভালোবাস। উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ এসবকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। মানস গঠনের নামে, অপরিপক্বতার সুযোগে উগ্রবাদীগোষ্ঠী নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করছে। এ আরেক চমক। এই চমক দেখাতে গিয়ে তারুণ্য তুমি শামসুর রাহমানকে আঘাত করেছ, হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করেছ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী প্রমুখকে হত্যার দায়িত্ব নিলে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৭১ সালে। ২১ আগষ্ট, রমনা বটমূল, উদীচী সম্মেলনের ঘটনা সবই উগ্রবাদের নষ্টচিন্তা। এসব নষ্ট-ভ্রষ্টদের ফাঁদে তারুণ্য পা দিচ্ছে, এখানে তোমার দোষ দেখিনি। তোমাদের পথ দেখাতে হবে। অস্ত্র দিয়ে, পেশীশক্তি দিয়ে তারুণ্যকে ফেরানো যাবে না।
তরুণ! আমাদের চারপাশের যতসব হতাশা আর দূরাশা, তাও এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তোমাদের জীবনগঠনে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন তারুণ্যের মানস গঠনে দরকার প্রয়োজনীয় আলো-হাওয়া-সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং পারিবারিকভাবে। তারুণ্য তোমার জন্য গাইতে হবে-সাম্যের গান। নজরুলের ভাষায় বলতে হবে- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই। নহে কিছু মহীয়ান।/নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে, তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,/এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’ তারুণ্য! তোমার উপলব্ধিতে এমনতর অনুভূতি আনতে হবে, আনার পথ সুগম করতে হবে। তারুণ্যের জয়গান গাইতে হবে। তাই আজাদীর প্রতি এই কৃতজ্ঞতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার