সরকারের আমদানিকৃত ৫শ কোটি টাকা দামের ইউরিয়া সার গায়েব করে দেওয়ার ঘটনার কুলকিনারা হয়নি। তদন্ত হয়েছে, তদন্তে ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। চিঠির পর চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের সার সরকারি গুদামে ঢোকেনি। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) আমদানি করা এই সার উদ্ধারে নানামুখী চেষ্টা ব্যর্থ হতে চলেছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। সার গায়েবে দায়ী করা হয়েছে বিসিআইসির অনুমোদিত পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সকে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নরসিংদী–২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের (বিএফএ) সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আশরাফ খান পোটন। চট্টগ্রাম থেকে দেশের বাফার গুদামগুলোতে পরিবহনের আড়ালে ১৪ লাখ ৫৩ হাজার ৬শ বস্তা সার গায়েব করা হয় বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়ে মামলা করেছে বিসিআইসি।
বিসিআইসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকার প্রতি বছর বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার সার আমদানি করে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চড়া দামে আমদানিকৃত সার ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু আমদানিকৃত ওই সার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পরিবহনকালে গায়েব করে দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৫টি বাফার গুদামের নামে ট্রাকে বোঝাই করা হলেও পথে সব সার বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এক–দুই ট্রাক নয়, সাত হাজারের বেশি ট্রাক বোঝাই সার খোলাবাজারে বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিসিআইসির তালিকাভুক্ত ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেশব্যাপী সার পরিবহন করত। এর মধ্যে পোটন ট্রেডার্স সার পরিবহনকালে ১৪ লাখ ৫৩ হাজার ৬শ বস্তা সার গায়েব করে। গায়েবকৃত সারের দাম ৫শ কোটি টাকার বেশি।
নরসিংদী–২ আসন থেকে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী সংসদ সদস্য এবং বিএফএ সভাপতি কামরুল আশরাফ খান পোটন উক্ত প্রতিষ্ঠানটির মালিক। পোটনের বিরুদ্ধে সার গায়েবের অভিযোগে বিসিআইসি মামলা দায়ের করেছে। মামলার বাইরেও নানাভাবে চেষ্টা করা হয় সারগুলো উদ্ধারে। কিন্তু গায়েব করা সার ফেরত দেওয়া হয়নি।
বিসিআইসির একজন কর্মকর্তা জানান, আমদানিকৃত সার পরিবহন ঠিকাদারের মাধ্যমেই পরিবাহিত হয়। ঠিকাদারদের সাথে সম্পাদিত পরিবহন চুক্তির ৪(বি) ধারা অনুযায়ী ডেলিভারি চালান ইস্যুর পর ৫০ দিনের মধ্যে বাল্ক ইউরিয়া ও ৪০ দিনের মধ্যে বস্তাভর্তি ইউরিয়া সার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হবে। এর মধ্যে বস্তাভর্তি সারগুলো সরাসরি বাফার গুদামে এবং বাল্ক হিসেবে আমদানিকৃত সার বস্তাভর্তি করার জন্য কোনো সার কারখানায় পৌঁছে দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু পোটন ট্রেডার্স বিসিআইসির বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত এবং আমদানি করা সার পরিবহনের আড়ালে ৭২ হাজার ৬৮০ টন সার গায়েব করে দেয়। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট ৮টি চালান থেকে উপরোক্ত সার গায়েব করে। ওই সময়ের মধ্যে পোটন ট্রেডার্স মোট ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯০০ টন সার পরিবহনের দায়িত্ব পায়। এর মধ্যে ৭২ হাজার ৬৮০ টন সার জাহাজ এবং কারখানা থেকে গ্রহণ করলেও গুদামে পৌঁছানো হয়নি।
একজন কর্মকর্তা বলেন, পোটন ট্রেডার্স অভিনব পন্থায় সার গায়েব করেছে। চালান গ্রহণের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গুদামে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সুকৌশলে গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ সার গন্তব্যে পৌঁছানো হয়নি। এক চালানের সার অপর চালানের দেখিয়ে বাফার গুদামে বুঝিয়ে দেওয়া হলেও চূড়ান্ত হিসেবে পোটন ট্রেডার্স ৭২ হাজার ৬৮০ টন সারের হিসাব দেয়নি।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত হয়েছে। কোন জাহাজ থেকে কত টন সার পোটন ট্রেডার্স গ্রহণ করেছে, কত টন গুদামে সরবরাহ দিয়েছে তার সবই পুঙ্খানুপঙ্খভাবে হিসাব করা হয়েছে। পোটন ট্রেডার্সকে সার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তাগাদা দেওয়া হয়েছে। সময়ও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাসের পর মাস গত হলেও তারা গায়েব করা সার ফিরিয়ে দেয়নি। দফায় দফায় চেষ্টা করেও সার ফেরত না পাওয়ায় পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।
বিসিআইসির শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে জানান, বিসিআইসি সার পরিবহন সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রমে পোটন ট্রেডার্সকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে পোটন ট্রেডার্সের মালিক আশরাফ খান পোটনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এসএমএস দেওয়া হলেও সাড়া দেননি।