গাজায় বিভীষিকাময় সাহ্‌রি-ইফতার

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | শনিবার , ৩০ মার্চ, ২০২৪ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

গত ১১ই মার্চ ভোর থেকে আরব বিশ্বে যখন মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে, তখন গাজার বাসিন্দারা মুখোমুখি হয়েছেন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার। যে রমজান মাসে মুসলমানরা সারা দিন রোজা রাখেন, অর্থাৎ খাবারপানি খাওয়া থেকে বিরত থাকেন, সেটি গাজাবাসীর সামনে দুর্ভিক্ষ হয়ে এসেছে। গত ছয় মাস ধরে যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন গাজার বাসিন্দারা। বাস্তবিক অর্থে এখনো সেখানকার সব মানুষ এখন খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছেন। এই জনপদের অভাগা মানুষগুলো মাসের পর মাস জুড়ে অনাহারে দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে।

বলা বাহুল্য, আরবের আকাশে সাঁঝের ছোঁয়া। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠছে বাতি। মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলেই মুখে ইফতারি তুলবেন সবাই। পবিত্র রমজানে মুসলমানদের কাছে এ এক উৎসবের মুহূর্ত। ঠিক একই সময়ে ফিলিস্তিনের গাজার চিত্রটা আলাদা। সেখানে ইফতারের জন্য নেই খাবার, নেই পানি, নেই কোনো আয়োজন। আছে শুধু ক্ষুধার্ত শিশুদের আর্তনাদ আর তাদের বাবামা পরিবারের সদস্যদের চেহারায় একরাশ হতাশা। ফিলিস্তিনিদের এবারের রোজার আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ইসরায়েলের নৃশংস হামলা।

অথচ এই গাজাতেই রোজা মানে ছিল উৎসব, আয়োজন, মানুষে মানুষে মিলে যাওয়া। এই তো গত বছরও পবিত্র রমজান উপলক্ষে সন্ধ্যা হলেই সেজে উঠত গাজার ঘরবাড়ি ও সড়কগুলো। জ্বলত রমজানের লণ্ঠন, রংবেরঙের বাতি। পাড়াপ্রতিবেশীদের নিয়ে আয়োজন করা হতো হরেক পদের ইফতারির। রাত গড়িয়ে গেলেও রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কমত না। আনন্দে মেতে উঠত শিশুরাও। সন্ধ্যার পর থেকে রাস্তায় খেলাধুলা করে, দল বেঁধে ধর্মীয় গান গেয়ে মাতিয়ে রাখত মহল্লা।

সাহ্‌রিইফতারে একটু ভালো খাবারের আয়োজন গাজাবাসীর কাছে এখন বিলাসিতা। দিনে এক বেলা এক মুঠো অন্ন জোগাড় করাই তো দায়। অসহায় মানুষগুলোর জন্য দরকারি ত্রাণও ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনী। সর্বত্র খাবারের জন্য তীব্র হাহাকার। আকাশ ছুঁয়েছে দাম। সংঘাতের আগের সময়ের তুলনায় ডিমের দাম বেড়েছে ১০ গুণ। আধা কেজি চিনির দাম বাংলাদেশের হিসাবে হাজার টাকার ওপরে (১০ ডলার)। খুঁজেও মেলে না তাজা ফল আর শাকসবজি।

রোজায় অনেকের অবস্থা আরও খারাপ। রাস্তায় রাস্তায় আবর্জনা হাতড়াতে দেখা গেছে অসহায় শিশুদের যদি উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার পাওয়া যায়। উত্তর গাজারবাসীর ভাষ্য, ‘শুধু রমজান নয়, বলতে গেলে প্রায় ছয় মাস ধরেই আমরা রোজা রাখছি’।

প্রসঙ্গত, গাজা যুদ্ধ ইতোমধ্যে ছয় মাস অতিক্রম করেছে। যুদ্ধ চলাকালে উপত্যকায় খাবার, ওষুধ, জ্বালানিসহ জীবনধারনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। এতে সেখানে ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ। চলতি সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাল হয় একটি ছবি। যেখানে দেখা যায়সারাদিন রোজা রাখার পর পশুর খাবার ঘাসের সঙ্গে লেবু দিয়ে ইফতার করছে ফিলিস্তিনের একটি পরিবার। গত মঙ্গলবার মিডল ইস্ট আইয়ের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এই ভিডিও ও ছবির মাধ্যমে পুটে ওঠেগাজায় ইসরায়েলি হামলায় কতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। নির্যাতিত ভাইদের এমন অসহায় রূপ দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় বিশ্বের ১৯০ কোটি মুসলমানের। অনেকেই জানান, এ দৃশ্য দেখার পরে ইফতার সামনে নিয়ে কান্না করেছেন তারা।

ছবিগুলো সামনে আসার পর অনেকেই প্রশ্ন করেন, ক্ষুধার তাড়নায় ফিলিস্তিনিরা যে ঘাস খাচ্ছেন, সেগুলো দেহের জন্য ক্ষতিকর কিনা? চিকিৎসকরা বলছেন, ঘাস বিষাক্ত কোনো কিছু নয়। কিন্তু এটি মানুষের জন্য ভালোও নয়। বিশেষ করে যদি দীর্ঘদিন খাওয়া হয়। কারণ, পানি আর লিগনিনের সমন্বয়ে তৈরি ঘাস। লিগনিন এমন একটি প্রোটিনযা মানুষের পাচনতন্ত্রের জন্য ভাঙা কঠিন। প্রাণীর জন্য, যেমন গরু, ঘাস খাওয়া কোনো সমস্যা নয়। কারণ তাদের পাচনতন্ত্র এটি সহ্য করতে পারে। কিন্তু ঘাসে অতিরিক্ত পরিমাণ সেলুলোস থাকার অর্থ হলো মানুষের জন্য এটির কোনো পুষ্টিগত উপকারিতা নেই।

এছাড়া মানুষের দাঁতের জন্য ঘাস ক্ষতিকর। কারণ ঘাসে প্রচুর পরিমাণ সিলিকা বা বালু থাকে। যা ধীরে ধীরে দাঁত নষ্ট করে ফেলতে পারে। কিন্তু প্রাণীর দাঁত এমনভাবে তৈরি যে এই সিলিকা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

পাশাপাশি ঘাসে প্রচুর পরিমাণ ময়লাও থাকে। অনেক জায়গায় ঘাসে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ঘাস খেলে মানবদেহে ক্যান্সার ও সন্তান জন্মদানগত সমস্যা হতে পারে।

উল্লেখ্য, গাজার মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস গত বছরের ৭ অক্টোবর দখলদার ইসরায়েলি সীমান্তে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১২০০ জনকে হত্যা এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করার পর গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। তারপর থেকে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৩১,৩০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যার মধ্যে ৭২ শতাংশ নারী এবং শিশু। ৭৩ হাজারের বেশি আহত হয়েছে এ যুদ্ধে।

লেখক

ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকজন পরিত্যক্ত
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে