কেবল মঞ্চে বসা অতিথিদের নয়, হলভর্তি মানুষের চোখও ভিজে যাচ্ছিল। মায়ের জন্য ভালোবাসা, পিতার জন্য ভালোবাসা, লেখাপড়ার জন্য ভালোবাসা-সর্বোপরি মানুষের জন্য ভালোবাসা আচ্ছন্ন করছিল মানুষকে। বৃত্তির টাকা পেয়ে লেখাপড়ার পথই শুধু নির্ঝঞ্ঝাট হবে না, একই সাথে মাকেও দুই ঘণ্টা কম পরিশ্রম করতে হবে। এমন বুকভাঙা গল্প হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছিল সকলের। একটি বনরুটি খেয়ে সারা দিন থাকার পরও ডাক্তারি পড়ার জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকার মতো ঘটনাও শোনাচ্ছিলেন মেধাবী মুখগুলো। জীবনে এত বেশি নীল নীল কষ্ট থাকে! বিবর্ণ জীবনের সব গল্প গতকাল বলা হয়েছে জাকির হোসেন রোডে লায়ন্স ফাউন্ডেশনের হালিমা রোকেয়া হলে। লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি৪ এর স্থায়ী প্রকল্প লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে পিনপতন নীরবতায় মানুষ শুনছিলেন একেকটি গল্প। প্রতিটি গল্পই মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। প্রতিটি গল্পই সবাইকে কাঁদাচ্ছিল।
লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি৪ এর স্থায়ী প্রকল্পের আওতায় গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চুয়েট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের মেধাবী ও গরিব ছাত্রছাত্রীদের মাঝে লায়ন্স স্কলারশিপ প্রদান করা হয়। মোট ৫০ জন ছাত্রছাত্রীকে বার্ষিক এককালীন ২৪ হাজার টাকা বৃত্তি প্রদান করা হয়।
বৃত্তি পাওয়ার পর নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করার সময় মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। কাঁদান হলের সবাইকে। তারা ভাবেন, মানুষকে এত সংগ্রাম করতে হয়! এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষে পড়া এক ছাত্রী লায়ন্স স্কলারশিপের বৃত্তির টাকা পাওয়ায় আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, লেখাপড়া করতে পারব এমন আশা আমার ছিল না। এইচএসসি পরীক্ষার সময় মা মারা যাওয়ায় চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছিলাম। তবুও ভালোভাবেই পাস করলাম। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেলাম। কিন্তু ভর্তি হব কীভাবে, পড়ব কীভাবে? টিউশনি করে কিছু টাকা যোগাড় করলাম, ভর্তি হলাম। হোস্টেলে সিটও নিলাম। কিন্তু তিন বেলা খাবারের সংস্থান করার মতো টাকা আমার ছিল না। টিউশনি করলে নিজের পড়া হয় না, আবার নিজের পড়া চালাতে হলে টিউশনি ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। হোস্টেলের খাবারের বিল দেয়ার মতো অবস্থা নেই। খাবার কেনার টাকা নেই। একটি বনরুটি খেয়ে বহুদিন কাটিয়েছি। বহু রাত না খেয়ে ঘুমিয়েছি। বান্ধবীরা আমার অবস্থা বুঝতে পারত। তারা হোস্টেলের খাবার থেকে আনলিমিটেড ডাল ও ভাত নিতে পারত। তারা আমার জন্য কিছু বাড়তি ভাত ও ডাল নিয়ে আসত। শুধু ভাত-ডাল খেয়ে বহু রাত কাটিয়েছি। বহুদিন ক্লাসে গিয়েছি কিছু মুখে না দিয়ে। এমন সময় আমার পাশে দাঁড়াল লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যানশাল। বৃত্তির টাকাটা পেয়ে আমার কষ্ট কমে গেল। আমি একটি ভরসার জায়গা পেলাম, আমার লেখাপড়া চালাতে পারব। ডাক্তার হতে পারব। আমাকে আর অনাহারে থাকতে হবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রিপল ই’র ছাত্র কাঁদতে কাঁদতে বললেন, লায়ন্সের বৃত্তির টাকা দিয়ে শুধু লেখাপড়ার পথই সুগম হলো না, একই সাথে আমার মাকেও দুই ঘণ্টা কম কাজ করাতে পারব। বাবা নেই। মা মানুষের বাসায় কাজ করেন। সকাল সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত কাজ করে দশ হাজার টাকা আয় করেন। তা দিয়ে তাদের সংসার এবং তার লেখাপড়ার খরচ চলে। লায়ন্স ক্লাব থেকে পাওয়া মাসিক দুই হাজার টাকার বৃত্তির ফলে তার মাকে দুই ঘণ্টা কম কাজ করতে হবে। এখন সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কাজ করে তার মা বাসায় ফিরতে পারবে। ঝিয়ের কাজ করে নিজের এবং সন্তানের ভরণ পোষণের সংস্থান করা মায়ের জন্য সন্তানের এমন ভালোবাসা উপস্থিত সকলকেই মুগ্ধ করে। এই ছাত্রের শান্তিতে থাকার জায়গা নেই। পেট ভরে দুই মুঠো খাওয়ার সংস্থান নেই। অথচ তিনি পড়ছেন ইঞ্জিনিয়ারিং। একজন মানবিক এবং সফল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদিন সুযোগ এলে তিনিও তার মতো অসহায় ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা করবেন।
আলো নেই চোখে। পড়ছেন মনের আলোতে। জন্মান্ধ। দেখেননি মা-বাবাকেও। তিল তিল করে এগিয়ে সেই ছাত্রটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ছেন। এই ধরনের তিনজন জন্মান্ধ ছাত্রকে গতকাল বৃত্তি প্রদান করা হয়।
পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রীর সকলের গল্পই প্রায় অভিন্ন। একই ধরনের অগুনতি গল্প জমা রয়েছে একদল ছাত্রছাত্রীর জীবনজুড়ে। এদের সবারই জীবন থমকে যাওয়া। পিতা নেই। পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। কারো পিতা আছেন, কিন্তু পঙ্গু। কারোবা পিতা অক্ষম। এদের কেউ পড়ছেন ডাক্তারি, কেউবা ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউবা অ্যাকাউন্টিং, কেউবা ব্যবসা প্রশাসন। আবার কেউ ইংরেজি।
তারা সকলেই কষ্ট করে পড়ছেন। যে কষ্ট কাঁদায়, হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আর তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করে লেখাপড়ার পথ সুগম করতেই লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের বৃত্তি প্রদান। এই ট্রাস্টের বৃত্তি নিয়ে অতি দরিদ্র পরিবারের কিছু মেধাবী সন্তান জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আসা মানুষগুলো নিজেদের বিবর্ণ জীবনের গল্প বলছিলেন।
যুদ্ধক্ষেত্রের নিরস্ত্র সৈনিক যেমন অসহায় ঠিক তেমনি অসহায় হয়ে সমাজের দিকে তাকিয়ে থাকা মেধাবী এসব ছাত্রছাত্রীর একেকজন পড়ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে, চুয়েট কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যুদ্ধজয়ের চেয়ে কঠিনভাবে তারা জয় করেছেন নানা প্রতিবন্ধকতা। নিজেদের জীবনের নানা কাহিনী তারা বলছিলেন সাবলীলভাবে। কিন্তু যারা শুনছিলেন তাদের চোখের কোণ ভিজে উঠছিল।
তাদের কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। কারো বাবা রিকশা চালান, ভ্যান চালান, কৃষি কাজ করেন। আবার কারোর মা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। শুধু কি তাই? এদের কয়েকজন জন্মান্ধ। চোখের দৃষ্টি নেই, পেটে ভাত নেই। অথচ মন পড়ে থাকে বইয়ের পাতায়। তারা পড়তে চান। মানুষ হতে চান। মন-প্রাণ উজাড় করে হতে চান মেধাবী মানুষ। মানবিক মানুষ। কিন্তু তাদের সামনে পাহাড়ের চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা দারিদ্র।
তারা বলছিলেন, এই বৃত্তি সামান্য নয়, অসামান্য বললেও কম বলা হবে। এই বৃত্তিই আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা এই বৃত্তি আমাদের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছে।
বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান পিডিজি লায়ন মোস্তাক হোসেন। ট্রাস্টি বোর্ডের ট্রেজারার লায়ন জাফরউল্ল্যাহ চৌধুরীর সঞ্চালনায় এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা গভর্নর লায়ন ডা. সুকান্ত ভট্টাচার্য। বিশেষ অতিথি ছিলেন ফাস্ট ভাইস ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর লায়ন আল সাদাত দোভাষ, সেকেন্ড ভাইস গভর্নর লায়ন শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে কেবিনেট সেক্রেটারি লায়ন অশেষ কুমার উকিল, কেবিনেট ট্রেজারার লায়ন আশরাফুল আলম আরজু বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত ছিলেন পিডিজি এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য লায়ন নাজমুল হক চৌধুরী, পিডিজি লায়ন সফিউর রহমান ও পিডিজি লায়ন সিরাজুল হক আনসারি।
লায়ন ডাক্তার সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেন, বৃত্তিপ্রাপ্ত প্রতিজন ছাত্রছাত্রীর কথা একান্তে আমরা শুনেছি। এদের কষ্টের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। একেকজন ছাত্রছাত্রী যে এত কষ্ট সহ্য করে এতদূর এসেছেন সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতে হয়, স্যালুট করতে হয়। এখন থেকে তাদের পাশে থাকবেন লায়ন্স সদস্যরা। এদের একজনকেও আর টাকার অভাবে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হবে না।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে এদের জন্য সর্বোচ্চটা করব। জীবন যুদ্ধে হার না মানা একেকটি মানুষ একদিন লায়নিজমের পতাকা ওড়াবে। তাদের শপথবাক্য পাঠ করিয়ে অঙ্গীকার করান, ভবিষ্যতে যখন তাদের অবস্থা পাল্টাবে, তারা যখন সফল হবেন, তখন তারাও যেন এভাবে ছাত্রছাত্রীদের পাশে থাকেন। এসব ছাত্রছাত্রী একেকজন মানবিক মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের স্বপ্নদ্রষ্টা সাবেক গভর্নর লায়ন মোস্তাক হোসাইন তিল তিল করে বেড়ে ওঠা ট্রাস্টের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, আমরা দশজনকে দিয়ে শুরু করেছিলাম। এ বছর পঞ্চাশ জনকে দিলাম। ভবিষ্যতে একদিন চার হাজার জনকে এই বৃত্তি প্রদান করা হবে। চট্টগ্রামের সিংহ হৃদয় মানুষগুলো নিজেদের হাত এই অভাবী অথচ মেধাবীদের পিঠে রাখলে তাদের পথ আলোকিত হবে। তারা সেই আলোয় আলোকিত করবে বাংলাদেশ। এরা একদিন লায়নিজমের একেকজন অ্যাম্বাসেডর হয়ে সমাজে কাজ করবে। ভবিষ্যতে এই সেবার পরিধি আরো বাড়ানোর জন্য লায়ন সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে চাই। আমাদের সাথে সাথে তাদেরকেও এগিয়ে নিতে চাই। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।