গরম বাড়াচ্ছে জ্বর-সর্দির ভোগান্তি

| শনিবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:১৬ পূর্বাহ্ণ

সপ্তাহখানেক আগে জ্বর-সর্দির সঙ্গে কাশি শুরু হয় মিরপুর ডিওএইচএসের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলামের। দুদিন পর দুই মেয়ে, ছেলে, স্ত্রীও জ্বর-ঠাণ্ডায় পড়লেন। করোনাভাইরাস মহামারী আর ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে ভয়ই পেয়ে গেলেন তারা। সেই ভয় থেকে দুই ধরনের পরীক্ষায়ই করাতে হল। তবে রিপোর্ট দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন রাকিবুল; দুটোই ‘নেগেটিভ’। ডাক্তার বললেন, সিজনাল জ্বর, অনেকেরই হচ্ছে। রাকিবুল বলেন, হঠাৎ হাঁচি, তারপর নাক দিয়ে পানি পড়া শুরু হল। সাথে হালকা জ্বর, একদিন পর বেড়ে গেল ১০২, ১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত। গায়ে ব্যথাও শুরু হল, শরীর খুব দুর্বল হয়ে গেল। এখন অনেকটা সেরে উঠলেও সর্দি আর দুর্বলতা ছাড়েনি। তার স্ত্রী হাবিবা ইসলাম জানালেন, জ্বরের সঙ্গে আর খুসখুসে কাশি ছিল। তাদের ৫ বছর ও ১২ বছর বয়সী দুই মেয়ের জ্বর ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে থাকলেও কাশি, সর্দি আর ঠাণ্ডার সমস্যা ছিল। ১৬ বছর বয়সী ছেলের জ্বর ছিল বেশি। খবর বিডিনিউজের।
কোভিড ও ডেঙ্গু পরীক্ষার ফলাফল ‘নেগেটিভ’ আসার পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এখন বেশি বেশি তরল খাবার ও ফলমূল খাচ্ছেন বলে জানালেন তিনি। চিকিৎসকরা বলছেন, শরতের শেষে এসে গরম বেড়ে যাওয়ায় জ্বর, সর্দি, কাশি বেড়েছে। রাজধানীতে অনেক পরিবারেই ভোগাচ্ছে মৌসুমি জ্বর।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক শফি আহমেদ জানালেন, তার হাসপাতালে এখন চিকিৎসা নেওয়া শিশুদের ৮০ শতাংশই আসছে জ্বর, সর্দি, কাশির সমস্যা নিয়ে। সাধারণ সর্দি-ঠাণ্ডা থেকে অনেক শিশুর ভাইরাল নিউমোনিয়া, ব্রোঙ্কিওলাইটিস বা শ্বাসকষ্টও হয়ে যায়। যেসব শিশুর অবস্থা গুরুতর, তাদের আমরা ভর্তি নিই। অধিকাংশই আউটডোরে সেবা নিয়ে বাসায় চলে যায়।
কিন্তু মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ডুইপ এলাকার দেড় মাস বয়সী আরহামের সমস্যা অত সহজে মেটেনি। সর্দি আর ঠাণ্ডার মধ্যে মায়ের দুধও খেতে পারছিল না শিশুটি। এখন তাকে আইসিইউতে রাখতে হয়েছে। তার মা ফারজানা ইয়াসমিন জানান, আস্তে আস্তে সেরে যাবে ভেবে তাকে শুরুতে কোনো চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়নি। পরে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলে জানা গেল, তার নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। ইনজেকশন শুরুর পরও অবস্থার অবনতি হতে থাকায় পল্লবীর ডিজিল্যাব হাসপাতালে নেওয়া হয় শিশু আরহামকে। মঙ্গলবার সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় ঢাকা শিশু হাসপাতালে। পরে বুধবার সকালে ভেন্টিলেশন সাপোর্টের জন্য চিকিৎসক তাকে আইসিইউয়ে নিতে বলেন।
ফারজানা ইয়াসমিন জানান, শিশু হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা না থাকায় অনেকগুলা হাসপাতাল ঘুরে একদিন পর আইসিইউ মিলেছে। কিন্তু হাসপাতালের খরচ নিয়ে তাকে দুঃশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে। জন্মের পর আহরামের কিছুটা জন্ডিস ছিল। কিন্তু ঠাণ্ডার সমস্যা ছিল না। গরমে শরীর ঘেমে ঠাণ্ডার সমস্যাটা দুই সপ্তাহ ধরে। প্রথমে জ্বর ছিল। নাপা খাওয়ালে জ্বর কমে যায়। সর্দিও একটু কমে গেছিল। তাই তখন আর ডাক্তারের কাছে নিইনি। কিন্তু অবস্থা এত খারাপ হবে ভাবিনি।
এই তরুণ মা আফসোস করে বলেন, আমার অবহেলার কারণেই বাচ্চাটার এমন হল। ভাবি নাই এত বেশি ঠাণ্ডা লেগে গেছে। কিন্তু যখন দুধ খাচ্ছিল না, মুখ থেকে ফ্যানা বের হচ্ছিল, তখন তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। বাবুকে দেখে ডাক্তার অনেক রাগারাগি করছে। এখন ভেন্টিলেশন ছাড়া শ্বাস নিতে পারছে না।
আশ্বিনের শেষ পর্যায়ে এসে রাজধানীবাসীকে ভুগতে হয়েছে ভ্যাপসা গরমের যন্ত্রণায়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ঢাকায় তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৫ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
গরমে ঘেমে অনেকেরই ঠাণ্ড লাগছে, জ্বর আসছে জানিয়ে অধ্যাপক শফি আহমেদ বলেন, এর প্রধান কারণ হচ্ছে গরম বেড়ে যাওয়া। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণও বেশি। এ কারণেই এই রোগগুলো হচ্ছে।
সেজন্য তিনি শিশুদের গরমে বের না করা, পানি ও তরল খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। এছাড়া যাদের সর্দি, কাশি, জ্বর আছে, তাদের কাছ থেকে বাচ্চাদের আলাদা রাখা ও বেশি জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগেও এখন ‘ভাইরাস জ্বরের’ রোগী বেশি জানিয়ে পরিচালক খলিলুর রহমান বলেন, এখন একটা ফ্লু দেখা যাচ্ছে। সেটা ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ভাইরাল ফ্লু। এখন গরমকাল চলছে, কিছুদিন পরই শীত আসবে। এই সময়টাতেই এই ভাইরাস জ্বর বেশি হয়। স্বাস্থ্যবিধি মানলে সব ভাইরাস থেকেই আমরা রক্ষা পাব। শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে ওদের বেশি হচ্ছে এই ভাইরাস জ্বর।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এ সময় প্রোটিন, টাটকা শাকসবজি, ফলমূল ও প্রচুর পানি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এ চিকিৎসক। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক কাজী মো. রশিদ উন নবী জানালেন, তার হাসপাতালেও এখন ‘সিজন্যাল ফ্লু’ নিয়ে রোগী বেশি আসছে। এখন মানুষ কিন্তু অনেক টেস্ট করাচ্ছে। কারণ তাদের জ্বর, সর্দি, কাশির মত লক্ষণগুলো আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছিল, তখন আমাদের এখানে টেস্ট করাতে আসত ১২০-১৩০ জন, কখনো বেশিও হত। ২০০ জনও হয়েছে। কিন্তু এখন কোভিড সংক্রণের হার দিনে ২ থেকে ৩ শতাংশ। অথচ এখনও ১৩০-৪০ জন টেস্ট করাতে আসছে। অর্থাৎ এদের মধ্যে অনেকেই আসলে মৌসুমি জ্বরের রোগী। যেহেতু মানুষ কোভিডের টেস্ট করছে, বোঝাই যাচ্ছে যে মানুষের জ্বর আছে বলেই আসছে। রশিদ উন নবী বলেন, এখন যে আবহাওয়া আর তাপমাত্রা চলছে, তা ভাইরাসের জন্য বেশি ‘উপযোগী’।
কেন হচ্ছে এই ভাইরাস জ্বর?
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের এই সময়ে ভাইরাস জ্বর ও ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ বাড়ে। সেজন্য বাইরে কম যাওয়া, ধুলোবালিতে কম যাওয়া, বাইরের খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এ জ্বরের কারণ যেহেতু ভাইরাস, পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে অন্যদের দূরত্ব রেখে চলতে হবে। এটার তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। এই ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশি বা জ্বর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সেরে যায়।
করোনাভাইরাস না হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ দিয়ে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানলে এই ‘সিজনাল জ্বরও’ এড়ানো যায়। এটাকে আমরা সেলফ লিমিটিং ভাইরাস বলি। এটা কোভিডের মতই সংক্রামক ভাইরাস। একে অপরের হাঁচি-কাশি থেকেই এটা ছড়ায়। করোনার মতই ভাইরাল ফিভার এটি, কিন্তু কোভিডের মত ভয়ঙ্কর নয়। এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস থেকেও হতে পারে। রেসপিরেটরি সিনসিশিয়াল ভাইরাসের কারণেও হতে পারে।
মৌসুমি এই রোগে আক্রান্ত হলে বাসায় বিশ্রাম নেওয়া, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সাবান দিয়ে হাত ধুয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এ সময়ে জ্বরের কারণে মুখে রুচি থাকে না। তবে পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। কারণ সর্দিতে পানি বের হয়ে যায় শরীর থেকে। পানি কমে গেলেই জ্বরটা আসে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাঁচ বছর পর রাঙ্গুনিয়ায় আজ ছাত্রলীগের সম্মেলন
পরবর্তী নিবন্ধ৫ মাস পর শনাক্ত চারশর নিচে