বীর চট্টগ্রামের মানবতাবাদী, জনদরদী, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অগ্রণী সংগঠক মুক্তিযুদ্ধকালীন দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের প্রধান বেসামরিক প্রশাসক, শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রদূত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সদস্য, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রী সভার সদস্য চট্টল গৌরব জহুর আহমদ চৌধুরী।
তিনি ১৯১৫ সালে চট্টগ্রাম শহরের ডবলমুরিং থানার উত্তর কাট্টলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল আজিজ চৌধুরী, মায়ের নাম জরিনা খাতুন। জহুর আহমদ চৌধুরীর প্রাথমিক শিক্ষা উত্তর কাট্টলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হন। রাজনীতির প্রতি অতি আকর্ষণ তাঁকে স্কুল বিমুখ করে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় এ দেশ হতে বৃটিশ বিতাড়নের ব্রত নিয়ে সকল রাজনৈতিক নেতার আবাস ও অবিভক্ত ভারতের রাজনীতির পাদপীঠ কলকাতা গমন করেন। কলকাতা গমনের পরেই মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের আশীর্বাদ সিক্ত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করেন এবং ১৯৪৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। এরপর শুরু হয় সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন। ফলশ্রুতিতে যৌবনের প্রারম্ভে ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ আমলে কলকাতার খিদিরপুর ডক শ্রমিকদের নেতৃত্ব দেন। খিদিরপুর ডক ইয়ার্ড শ্রমিক সংগঠনটি সর্ব ভারতীয় হওয়ায় এ সংগঠনের নেতৃত্বে দেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ভি. ভি গিরি। মহান নেতা ভি. ভি গিরির হাতেই জহুর আহমদ চৌধুরীর রাজনীতির হাতেখড়ি। শ্রমিক নেতৃত্ব দেয়ার পিছনে তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হলো তাঁর নিজের জীবন দৈন্যতার মধ্যে কাটে বিধায় অভাবগ্রস্ত শ্রমিকেরা কিভাবে যে দিন কাটে সেটা তাঁর বিবেককে সর্বদা আঘাত করতো। তাই তিনি অর্থ উপার্জনের লিপ্সা পরিহার করে সর্বদা নিঃস্বার্থভাবে শ্রমিকদের সেবা করতে মনস্থ করেন।
তদানুযায়ী তিনি সর্বকালব্যাপী শ্রমিকদের সেবা করে গেছেন। ব্রিটিশ আমল থেকে তিনি শ্রমিক নেতা হিসাবে আখ্যায়িত ছিলেন। সে সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম কাঁহার পাড়া জ্বালিয়ে দেওয়া হলে জহুর আহমদ চৌধুরী কাঁহার পাড়াবাসীদের সাথে নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝঁঁঁঁঁঁাঁপিয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে কাঁহার পাড়াবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৪৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ১৯৪৬ সালে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে সিলেটে গণভোটে অংশ নেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর নারায়নগঞ্জে গড়ে তোলে জাহাজি শ্রমিক ইউনিয়ন এবং তিনি এ সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটে অংশ নেন।
ভারত বিভক্তির পর পাক আমলে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্যে ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হল। তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। সেই সময় হতে তিনি চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নিযুক্ত হন এবং স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত সেই পদে বহাল ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে তিনি আওয়ামী লীগ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। শ্রমিক সেবার নিদর্শনস্বরূপ তৎকালে স্টেশন রোডস্থ ‘ডাকবাংলাতে’ অবস্থান নিয়ে তিনি মালিকদের থেকে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের ব্যাপারে সর্বদা সংগ্রামে লিপ্ত থাকতেন। শ্রমিকদের পক্ষে সংগ্রামে লিপ্ত থাকা ছিল তাঁর জীবনের শপথ। ১৯৫০ সালে ঢাকা হতে চট্টগ্রাম ফিরে এম.এ. আজিজ এর সহযোগে চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের শাখা গঠন করেন এবং চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামে খাদ্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারাবরণ করেন।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং পুনরায় গ্রেফতার হন। সে সময় তিনি চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে বাঙালি পুলিশের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে পুনরায় কারাবরণ করেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট কমিটি জহুর আহমদ চৌধুরীকে যুক্তফ্রন্ট থেকে চট্টগ্রাম শহর আসনে মনোনয়ন দান করেন। উনি যার সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি হলেন চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। যিনি বর্তমান রিয়াজ উদ্দিন বাজারের মালিক। এমন একজন ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে জহুর আহমদ চৌধুরী জনপ্রিয়তা বলে বিপুল ভোটে পরাজিত করে পুরা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এরপর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট সরকার অপসারণ হলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন এবং চট্টগ্রাম ‘ডক’ এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদিঘির ময়দানে ঐতিহাসিক ৬ দফার ঘোষণার জনসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। এ জনসভা হতেই ৬ দফা দাবি যা বাঙালির ম্যাগনাকার্টা হিসেবে পরিচিত তা বঙ্গবন্ধু এ জনসভা হতেই ঘোষণা করেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদে আওয়ামী লীগ হতে জহুর আহমদ চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হয় এবং তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে পূর্বাঞ্চলীয় জোনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাত্রে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণাটি ওয়্যারলেসযোগে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে পাঠান এবং জহুর আহমদ চৌধুরী এ ঘোষণাটি আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব নিয়েই প্রচার করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ও মেধাবী ছাত্র নেতা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী সম্মুখযুদ্ধে নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথমে ইস্টার্ন লিবারেশন কাউন্সিল ওপরে জোনাল এ্যান্ড মিনিস্ট্রেটিড কাউন্সিল সাউথ ইস্ট জোন-২ এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন এলাকায় তখন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন ১০৩ জন। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে প্রথম বিজয় পতাকা তিনি উত্তোলন করেন। সরকারের পক্ষে প্রথমে কুমিল্লা ও পরে ঢাকায় প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন এবং ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে প্রথম বেতার ভাষণ দেন। ১৯৭২ এর ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভায় ৮টি দফতরের অর্থাৎ স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজ কল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীপদে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
মন্ত্রী হয়ে তিনি এদেশে বসবাসরত অবাঙালিদের সম্পত্তি ও ব্যবসা বাণিজ্য বাঙালি অবৈধ দখলকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদেরকে দ্রুত হস্তান্তর করেন। এর ফলশ্রুতিতে অবাঙালি মালিকেরা আজ অবধি তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে। তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন সহজ, সরল ও উদার ব্যক্তি ছিলেন। বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ এর মার্চ এ দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের ৯ নং নির্বাচনী এলাকা হতে বিপুল ভোটে তিনি পুনরায় জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের দ্বিতীয় মন্ত্রীসভায় শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৭৪ সালের ১ জুলাই সকাল ৬.৪৫ মিনিটে জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে দুপুর ১২ টায় দামপাড়াস্থ তাঁর বাসবভন সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। আওয়ামীলীগ নেতাদের মধ্যে একমাত্র জহুর আহমদ চৌধুরীই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সামরিক মর্যাদায় সমাহিত হয়েছিলেন। জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন বাঙালির প্রাণের পুরুষ। বাঙালির প্রাণের স্পর্শটুকু তিনি অনুভুব করেছিলেন শুধু তা নয় জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই তা লালন করেছেন। সংগঠক হতে নেতৃত্বের আসনে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন, অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, কোথাও থেমে থাকেন নি, আপসহীন লড়াকু মনোভাব নিয়ে বাঙালি জাতির বিকাশের পথ পরিক্রমার অন্যতম সংগঠক, পরিকল্পনা বিশারদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ত্যাগ-তিতিক্ষা, সততা-একনিষ্ঠতা, অধ্যবসায়-শ্রম-কর্মনিষ্ঠতা-দূরদর্শিতা তাকে সাধারণ হতে অসাধারণে পরিণত করেছিল। কর্মী হতে জননেতাই পরিণত হয়েছিলেন। আজকে বিভেদময় ও নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজে ও আদর্শহীন নেতার ভিড়ে জহুর আহমদ চৌধুরীর নির্লোভ ও আদর্শবাদী জননেতার বড়ই প্রয়োজন ছিল।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী