স্ত্রী নেই। চার সন্তানের তিনজনই তার সাথে থাকে না। সবার ছোট ছেলে মো. কামাল উদ্দিনকে (১৪) নিয়ে নগরের ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় ভাসমান হিসেবে দিন যাপন করেন আলী কাউছার। সে স্টেশনেই বেড়ে উঠা মা-বাবাহীন রাকিবের। এ সূত্রে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে কামালের সঙ্গে। তার পিতাকে আব্বু বলেই ডাকে রাকিব। থাকতও একসঙ্গে। গত সোমবার বিকেলে কামালকে সাথে নিয়ে ষোলশহরস্থ চশমা খালে নামে রাকিব। খেলার সময় স্রোতের মুখে পড়ে দু’জনই। রাকিব শেষ পর্যন্ত উঠতে পারলেও হারিয়ে যায় কামাল। গত রাত পর্যন্ত তার সন্ধান মিলেনি। এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দিনের উদ্ধার কাজ শেষ করে ফিরে যায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে খাল পাড়ে থেকে যায় কামালের দুই স্বজন তথা বন্ধু রাকিব ও বাবা আলী কাউছার। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছে আছে তারা। রাকিবের আশা, ফিরে আসবে তার ভাইয়ের মত বন্ধু। বাবা চান, অন্তত লাশটা যেন ফিরে পান।
উল্লেখ্য, ফায়ার সার্ভিস কামাল নিখোঁজের খবর পায় মঙ্গলবার। ওই দিন বিকেল চারটার পর থেকে ডুবুরিসহ তিনটি ইউনিট কামালকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করে। মাঝখানে একদিন কামালের বাবাই ছেলের খোঁজ করে। তখনো সাথে ছিল রাকিব। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলী কাউছার বাবা বলেন, আমার বাবাটা সোমবার চারটার বের হয়েছিল। আমার কাছ থেকে ১০ টাকাও নিয়েছিল। বাবাটা কয় চলে গেল। তাকে কোথায় পাব। তিনি বলেন, ছেলেকে জীবিত ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা তো নেই। সেটা বুঝতে পারছি। আমার বাবার লাশটা যেন অন্তত পাই। উদ্ধার কাজ চলাকালে দেখা গেছে, স্কেভেটর দিয়ে কোনো ময়লার স্তুপ তুললেই ছুটে যান তিনি। যদি সেখানে সন্তানের মরদেহ মিলে, এ আশায়। রাকিব জানায়, স্টেশনের পাশে কলোনিতে একটি বাসায় তিনজন একসঙ্গে থাকত। তবে বেশ কিছুদিন ধরে স্টেশনের ওভারপাসের নিচে থাকে। কামাল তার ভাইয়ের মত। কামালসহ দুজনই একসঙ্গে কখনো খবরের কাগজ বিক্রি করত। আবার কখনো বোতল-প্লাস্টিক কুড়িয়ে বিক্রি করত ভাঙারির দোকানে। সাথে তাদের বাবা আলী কাউছার দিনমজুরি করে যা পেত তা দিয়ে সংসার চলত। কামালকে হারিয়ে কিছুই ভালো লাগছে না বলে জানায় রাকিব। খেতেও ইচ্ছে করে না। গতকাল দুপুরে জোর করে পাশের একটি হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাদের খাওয়ায় বেসরকারি সংস্থা কোডেক-এর কর্মী মোহন। যিনি আগের দিন ফায়ার সার্ভিসে কামাল নিখোঁজের খবর দিয়েছিলেন কামালের।
রাকিব সোমবারের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, বড় লোকেরা পানিতে ভেসে থাকে সেরকম হলুদ একটা ফোম দেখে আমি ও কামাল পানিতে নামি। ওটা নিয়ে আমরা খেলিও। হঠাৎ স্রোতে সেটা উল্টে যাই। তখন আমি দেয়ালের সাথে লেগে আটকে যাই, কামাল স্রোতে ভেসে যায়। রাকিব জানায়, অনেক ডাকাডাকির পরও কামাল সাড়া না দেয়ায় ভয়ে স্টেশনে ফিরে আসে। সে একই ভয় থেকে কাউকে জানায়ওনি। সন্ধ্যার পর তাদের বাবাকে জানায়।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দিনের মত উদ্ধার কাজ শেষ করি। আগামীকাল (আজ) আবারও উদ্ধার কাজ চালানোর পরিকল্পনা আছে। শপিং কমপ্লেঙের সামনে রাস্তার নিচ দিয়ে যাওয়া ক্রস ড্রেনে গতকাল উদ্ধার কাজ চালানো হয়েছে বলে জানান তিনি। আগের দিনের ন্যায় গতকালও ময়লা-আর্বজনার জন্য উদ্ধার কাজ চালাতে বেগ পেতে হয় বলেও জানান তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর সামশুল আলম সাংবাদিককের বলেন, ঘটনাস্থল এবং আশপাশের নালা থেকে ১০ টন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে প্লাস্টিকের বোতল, ককশিট ও পলিথিন। শিশুটি এখানে আটকে আছে নাকি পানিতে তলিয়ে আরও দূরে চলে গেছে সেটি বলা খুব মুশকিল।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট চশমা খালের মুরাদপুর অংশে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হন সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ। এর আগে গত ৩০ জুন একই খালের মেয়র গলি এলাকায় পড়ে যায় একটি সিএনজি অটোরিকশা। এতে অটো রিকশা চালক ও এক যাত্রী মারা যায় দুইজন। এ ছাড়া ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহেরিন মাহবুব সাদিয়া। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে উদ্ধার হয় সাদিয়ার মরদেহ। নগরে খাল-নালায় পড়ে প্রাণহানির জন্য চসিক ও সিডিএকে দায়ী করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। অবশ্য গত মঙ্গলবার উদ্ধার কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী কামালের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নন বলে মন্তব্য করেন।