ক্ষুধামুক্তির লড়াইয়ে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে গত এক বছরে। ক্ষুধার সূচকে রীতিমত ১৩ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল ১৭ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট শুক্রবার চলতি বছরের ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’ প্রকাশ করেছে, তাতে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উঠে এসেছে ৭৫তম অবস্থানে। গতবছর এই সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮তম। তার আগের তিন বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৮৬, ৮৮ ও ৯০ নম্বরে। কেবল সূচকের অবস্থানে অগ্রগতি নয়, যে চার মাপকাঠিতে বিচার করে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেঙ (জিএইচআই) করা হয়, তার সবগুলোতেই গতবারের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে।
রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘অন্ন চিন্তা চমৎকার’। বিশেষজ্ঞদের মতে, রামকৃষ্ণের চিন্তাকেও ভাববাদের জগৎ অতিক্রম করে অতিবাস্তব জগতের সামনে আসতে হয়েছে। বলতে হয়েছে পেটে ভাত না থাকলে কালিদাসও বুদ্ধিহারা হবেন। খাদ্য বেঁচে থাকবার প্রাথমিক শর্ত, এ সহজ সরল সত্যটা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। খাদ্য সঞ্চয় ও উৎপাদিত ফসলের বণ্টনের ধরন সামজিক শ্রেণী কাঠামো গড়ে তোলবার মৌলিক ভিত্তি, একথা তো বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের এক স্বীকৃত চর্চা। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের গ্রীসে হেসিয়ডের ‘ওয়ার্কস এন্ড ডে’স’ গ্রন্থেও সমাজ প্রতিষ্ঠার আদি ভিত্তি হিসেবে খাদ্য সঞ্চয়কেই বোঝানো হয়েছিল। আমাদের দেশে বৈদিক সাহিত্যে ক্ষুধা ও খাদ্যের অ-প্রাচুর্যতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। পুরাণেও এ সত্য স্বীকৃত। বৈদিক সাহিত্যে অন্নের অনেক গৌরব কীর্তন করা হয়েছে। সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ‘এই মহিমা কীর্তন দেখে স্বভাবতই মনে হয় ক্ষুধা সম্পর্কে একটা আতঙ্কের মনোভাব জনমানসে কার্যকরী ছিল।’
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এ দেশে প্রায়ই খাদ্যাভাব দেখা দিতো, দুর্ভিক্ষ হতো। খাদ্য নিরাপত্তাকে সব সময়ই মনে করা হতো অধরা হরিণের মতো যা অর্জন করা কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু বিগত ১০ বছরে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝেও এ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের (চাল, গম ও ভুট্টা) উৎপাদন কমেনি। এ কথা সর্বোতোভাবে স্বীকৃত যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তাঁর সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে, কাজেই এদেশে আর কোনদিন কেউ না খেয়ে থাকবে না। তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তাটা যেন নিশ্চিত থাকে এবং প্রতিটি মানুষের ঘরে যেন খাবার পৌঁছায় সেজন্য হতদরিদ্রের মাঝে আমরা বিনে পয়সায় খাবার দিয়ে যাচ্ছি এবং এটা আমরা সব সময় অব্যাহত রাখব। একটি মানুষও যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়। একটি মানুষও আর গৃহহীন থাকবে না। তিনি বলেন, আসুন এই বিশ্বকে আমরা ক্ষুধামুক্ত করি এবং জাতির পিতা যে চেয়েছিলেন-ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আমরা তা অর্জন করতে পারব। তিনি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সাহসী এবং তারা যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখে। এই করোনার সাথে সাথে ঝড়, বন্যা সবই আমরা মোকাবেলা করে যাচ্ছি। এভাবে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বাঁচতে হবে।
জাতিসংঘের চারটি বিশেষায়িত সংস্থা আগেই সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছিল, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো যদি সব ধরনের অপুষ্টির অবসানে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষুধামুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় নিজেদের পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হয়, তাহলে এই অঞ্চলের মানুষ ও অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে, যা আমাদের প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে দেয়। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার এ বছর দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তেমন পরিস্থিতিতে ক্ষুধার সূচকে ১৩ ধাপ অগ্রগতি আমাদের আশান্বিত করে। দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি যেন ঝুঁকির মধ্যে না থাকে, তার জন্য আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে।