খাদ্যে ভেজাল ও দূষণরোধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে

| বৃহস্পতিবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের বাজারগুলোর পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ। খাদ্যে ভেজাল প্রবেশ করার মতোই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে খাদ্য দূষিত হচ্ছে। এককভাবে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ালে চলবে না, এর গুণগত মান ও স্বাস্থ্যসম্মত দিকটিও গুরুত্ব দিতে হবে।
টিআইবি’র রিসার্চ অ্যান্ড পলিসির জনৈক প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ২০১৩ সালে আমরা ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ, সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালনা করি। এখানে সুশাসনের চারটি নির্দেশক অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সেবার মান এবং দুর্নীতি। এ গবেষণায় আমরা ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করি। এগুলো হলো: পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কাস্টম হাউজ, মোবাইল কোর্ট। আমরা চারটি পরীক্ষাগারকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম- পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরি, পাবলিক হেলথ ফুড ল্যাবরেটরি, বিএসটিআই ও কাস্টম হাউজগুলোর ল্যাবরেটরি। গবেষণায় আমরা দেখেছিলাম, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নিরাপদ খাদ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তদারকি প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যনিরাপত্তার তিনটি উপাদান- ফুড প্রডাকশন, অ্যাক্সেসেবিলিটি ও ইউটিলাইজেশন। খাদ্য উৎপাদনে আমরা অনেকটাই এগিয়ে গেছি। অনেক খাবার আমাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এসেছে। অথচ আমরা যেখানে হোঁচট খেলাম, সেই জায়গাটা হলো ইউটিলাইজেশন। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার এখনো পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে ফুড কম্পোজিশন টেবিলের জন্য ফুড অ্যানালাইসিস করার সময় অনেক খাবারেই আমরা প্রচুর পরিমাণে হেভি মেটালস পাই। এছাড়া শিল্পবর্জ্য পোলট্রি ফিডে ব্যবহারের কারণে ডিম ও মুরগির মাংসে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতিও ধরা পড়ে। আমাদের গবেষক দল ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রচেষ্টায় সে সময় এর উৎস আবিষ্কার করতে সক্ষম হই। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারি উদ্যোগে পোলট্রি ফিডে ট্যানারি ওয়েস্ট বন্ধ হয়। একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, দুধে পানি মেশালে তা ভেজালের মধ্যে পড়ে। আর পানি যদি নিরাপদ হয়, তাহলে দুধ অনিরাপদ হয়ে যাবে না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, এতে দুধের পুষ্টিগুণ কমে গেল। নিরাপদ খাদ্য যদি নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে অবশ্যই পণ্যের গায়ে যাবতীয় তথ্য উল্লেখ করতে হবে। খাদ্যের পুষ্টিগুণ, কোন উপাদান কী পরিমাণে মেশানো হয়েছে, সবকিছুর উল্লেখ থাকতে হবে।
সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, খাদ্যে ভেজাল ও দূষণরোধে সচেতনতা তৈরির চেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে, সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্য নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায়নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান ও দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করা না হলে যতই সমস্যার কথা বলা হোক তা সমাধানের উপায় বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়বে। খাদ্যে ভেজালের চেয়েও দূষণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় কাঁচাবাজারগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে সচেষ্ট হতে হবে। এক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনকে নিয়মিত আলোচনা করে নিজ নিজ কর্মপরিধি তৈরি করতে হবে। পরিষ্কার বাজারের বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে সবাইকেই। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। কারণ তারা খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করে ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিরাপদ খাদ্য প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানগুলোয় শক্তিশালী ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ খাদ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাঠদান শুরু করা জরুরি। কর্তৃপক্ষকে নিরাপদ খাদ্য বাস্তবায়নে খাদ্যশিক্ষা ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য প্রদান ও গবেষণা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট একাডেমির সঙ্গে কার্যকর যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। এসডিজির সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পুষ্টি, শিক্ষাসহ বহুমাত্রিক বিষয় জড়িত। তাই নীতিনির্ধারকদের কাছে এ বিষয়গুলো উপস্থাপন করে শুধু ভেজাল প্রতিরোধই নয়, দূষণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়ার জন্য জোরালো অবস্থান তুলে ধরা যেতে পারে। অবৈজ্ঞানিক সচেতনতার মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্তিতে না ফেলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে খাদ্যে ভেজাল ও দূষণ থেকে সাধারণ মানুষকে সচেতন রাখতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের শক্তিশালী ভূমিকা দেখতে চাই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পণ্যের আদর্শগত মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন করতে হবে। মান নিয়ন্ত্রণে আরো ক্লোজ মনিটরিং দরকার। বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করা ল্যাবরেটরিগুলোর মাঝে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা দরকার। বিভিন্ন ল্যাবরেটরি বিশ্লেষণে ফি হ্রাস করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে