কয়েকশ কোটি টাকার মাছ উৎপাদনের সম্ভাবনা শেষ

হালদায় লবণাক্ত পানি, হ্যাচারিতে অব্যবস্থাপনা মিঠা পানির অভাবে নষ্ট ২-৩ হাজার কেজি ডিম

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৩০ মে, ২০২১ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

নানা অব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সরকারি হ্যাচারিগুলো ক্রমে পরিত্যক্ত হতে চলেছে। বেহাল হ্যাচারিগুলোতে ডিম ফোটাতে গিয়ে নাজুক পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন ডিম সংগ্রহকারীরা। শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনার কারণে এবার হালদা থেকে সংগৃহীত ডিম থেকে কয়েকশ কোটি টাকার রুই জাতীয় মাছ উৎপাদনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। মিঠা পানির সংস্থান না থাকায় নদীর লবণাক্ত পানিতে ডিম ফোটাতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে কয়েক হাজার কেজি ডিম। এর ফলে এই অবস্থা হয়েছে।
জানা যায়, হালদা থেকে সংগৃহীত ডিম ফোটানোর জন্য সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৭টি হ্যাচারি রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি সরকারি এবং একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইডিএফ-পিকেএসএফ পরিচালিত। হাটহাজারী ও রাউজানে এসব হ্যাচারি গড়ে তোলা হয়েছে। হাটহাজারীর মদুনাঘাট, মাদারী খালের মুখ ও মাছুয়াঘোনা এলাকায় এবং রাউজানের পশ্চিম গহিরা, মোবারকখীল ও কাগতিয়ায় সরকারি হ্যাচারি রয়েছে। আইডিএফ-পিকেএসএফ পরিচালিত হ্যাচারিটি রাউজানের বিনাজুরিতে অবস্থিত। সাতটি হ্যাচারি ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে ১৭৬টি মাটির কুয়া রয়েছে। ওখানে সনাতন পদ্ধতিতে ডিম থেকে রেণু ফোটানো হয়। সরকারি ছয়টি হ্যাচারির দুটি পরিত্যক্ত। বাকি চারটিতে সমস্যার অন্ত নেই। বেসরকারি হ্যাচারিটির অবস্থা ভালো। সনাতন পদ্ধতির কুয়াগুলোও ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মদুনাঘাটের বড়ুয়া পাড়ার সরকারি হ্যাচারিতে তিনটি গোলাকার এবং ১১টি চার কোণার কুয়া রয়েছে। এছাড়া প্লাস্টিকের কুয়া রয়েছে ১০টি। শাহ মাদারী হ্যাচারিতে চার কোণ কুয়া রয়েছে ৪৫টি, মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে চার কোণ কুয়া ৪৫টি এবং প্লাস্টিকের কুয়া রয়েছে ৩টি। পশ্চিম গহিরা হ্যাচারি এবং কাগতিয়া হ্যাচারি পরিত্যক্ত। এর কোনো কুয়াতেই ডিম ফোটানো হয় না। মোবারকখীল হ্যাচারিতে গোলাকার কুয়া রয়েছে ৬টি এবং চার কোণা কুয়া রয়েছে ১০টি। বেসরকারি হ্যাচারিটিতে চার কোণা কুয়া রয়েছে ১০টি এবং গোলাকার কুয়া রয়েছে ৬টি। একেকটি কুয়ায় চার থেকে ছয় বালতি বা ৬০ থেকে ৮০ কেজি ডিম দেওয়া যায়। ডিমের মানের উপর প্রতি ৪০ থেকে ৬০ কেজিতে এক কেজি রেণু উৎপাদিত হয়। এক কেজি রেণুতে গড়ে আড়াই লক্ষ পোনা থাকে। এক বছরের ব্যবধানে এর দাম দাঁড়ায় ৪-৫ কোটি টাকা। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হয়ে গেছে। শুধুমাত্র মিঠা পানির অভাবে দুই-তিন হাজার কেজি ডিম নষ্ট হয়ে গেছে।
ডিম সংগ্রহকারীরা জানিয়েছেন, নদী থেকে সংগৃহীত ডিম ফোটানোর ক্ষেত্রে মিঠা পানির গুরুত্ব অপরিসীম। কুয়াতে মিঠা পানি ব্যবহার করে ডিম ফোটাতে হয়। কিন্তু এবার হ্যাচারিগুলোতে মিঠার পানির আকাল দেখা দেয়। সময়মতো পাম্প মেশিন ঠিক না থাকায় পানির জন্য হাহাকার করেন ডিম সংগ্রহকারীরা। সকাল নয়টার মধ্যে ডিম নিয়ে হ্যাচারিতে পৌঁছলেও পানি পেয়েছেন দুপুর বারোটার পর। তা-ও আবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে লবণাক্ত হয়ে ওঠা হালদার পানি। অতিমাত্রায় লবণাক্ত এই পানি ব্যবহার করায় কুয়াগুলোতে শত শত কেজি ডিম নষ্ট হয়ে যায়।
এদিকে হালদা পাড়ে বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা ১৭৬টি মাটির কুয়ার প্রতি ডিম সংগ্রহকারীদের আগ্রহ থাকে বেশি। মাটির কুয়ায় ফোটানো ডিমে হালদার মাছের অরজিন্যাল চরিত্র থাকে। এতে করে কুয়ার রেণুর দাম থাকে সবচেয়ে বেশি। ক্রেতারাও আগ্রহী থাকেন। এবারও ১৭৬টি মাটির কুয়ায় বিপুল পরিমাণ ডিম ফোটানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হালদার জোয়ারের লবণাক্ত পানির কারণে কুয়ার ডিমও নষ্ট হয়ে যায়।
সরকারি চারটি হ্যাচারির মধ্যে দুটি এবং বেসরকারি একটি হ্যাচারিতে ডিম ফোটানোর কাজ ভালোভাবে হয়েছে। এসব হ্যাচারিতে মিঠা পানির পুকুর রয়েছে। পুকুরের পানি ব্যবহার করায় ডিম থেকে রেণু ফোটানোর প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছে, এবার গতবারের মাত্র এক চতুর্থাংশ ডিম সংগৃহীত হয়েছে। প্রাথমিক হিসেবে বলা হয়েছে, মাত্র সাড়ে ছয় হাজার কেজির মতো ডিম সংগ্রহ হয়েছে। এখান থেকে প্রায় ১৩০ কেজি রেণু পাওয়া যেত। যা থেকে কোটি কোটি মাছ উৎপাদন হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিঠা পানির সংস্থান না থাকায় কয়েক হাজার কেজি ডিম নষ্ট হয়ে গেছে। এতে এবার রেণুর পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে।
হালদা গবেষক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, হ্যাচারিগুলোতে প্রচুর অব্যবস্থাপনা রয়েছে। বছরে মাত্র তিন-চার দিন ব্যবহৃত হওয়ার ফলে অধিকাংশ হ্যাচারিতে কুয়ার দিকে খেয়াল রাখা হয় না। কোনো কোনো হ্যাচারির অবস্থা খুবই ভালো হলেও অধিকাংশ হ্যাচারিতে কুয়ার অবস্থা বেহাল। এবার মিঠা পানির সংস্থান না থাকায় প্রচুর ডিম নষ্ট হয়েছে। তবে কী পরিমাণ ডিম নষ্ট হয়েছে তা নিয়ে কোনো স্টাডি হয়নি।
তিনি বলেন, কোন হ্যাচারি থেকে কী পরিমাণ রেণু পাওয়া যাচ্ছে আজ-কালের মধ্যে তার হিসেব পাওয়া যাবে। এরপর কী পরিমাণ ডিম নষ্ট হয়েছে তা হিসাব করা যাবে। ব্যক্তি মালিকানাধীন মাটির কুয়াগুলোতেও প্রচুর ডিম নষ্ট হওয়ার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, লবণাক্ততাই এবার হালদার জন্য কাল হয়েছে। লবণাক্ততার জন্য যেমন নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারেনি, তেমনি সংগৃহীত স্বল্প পরিমাণের ডিমও লবণাক্ততার শিকার হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। শত শত কেজি ডিম নষ্ট হয়েছে।
একাধিক ডিম সংগ্রহকারী নিজেদের বিপর্যয়কর অবস্থা তুলে ধরে গতকাল আজাদীকে বলেন, শুধুমাত্র মিঠা পানির সংস্থান না থাকায় বহু কষ্টে সংগৃহীত ডিম হ্যাচারি পর্যন্ত আনার পরও নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ এগুলো থেকে রেণু ফোটানো সম্ভব হলে কোটি কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হতো।
সংশ্লিষ্ট একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছর হালদার পানি দিয়ে হ্যাচারিতে কাজ চলে। এবার নদীর পানি সহনীয় মাত্রার ৩৬ গুণ বেশি লবণাক্ত হয়ে যাবে তা কারোর ধারণায় ছিল না। এতে করে মিঠা পানির সংস্থান রাখা হয়নি। মিঠা পানির সংস্থান করা গেলে এতগুলো ডিম নষ্ট হতো না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও একজনের মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধনতুন শর্তে আরেক দফা বাড়তে পারে লকডাউন