ক্ষতিগ্রস্ত সেন্টমার্টিনে হুমকির মুখে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

‘সমন্বয়হীনতায় টেকসই বেড়িবাঁধ হচ্ছে না, বহুমুখী পদক্ষেপ দরকার’

টেকনাফ প্রতিনিধি | শনিবার , ২৭ মে, ২০২৩ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

ঘূর্ণিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপের হাজারের অধিক ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। উপড়ে গেছে কয়েক হাজার গাছপালা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কটেজদোকানপাট। এছাড়াও চারপাশের চর, সাগর পাড় ও সমুদ্র সৈকত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার কারণে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বাড়িয়েছে ঝুঁকি। এমনিতে পর্যটন মৌসুমে দ্বীপে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সেখানকার ইকোসিস্টেম অর্থাৎ প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছিল। এখন ঘূর্ণিঝড় মোখা সেটিকে আরও বেগবান করছে।

স্থানীয় চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, পরিকল্পনার অভাব ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতার কারণে দ্বীপের চারপাশে পর্যটনবান্ধব ও টেকসই বেড়িবাঁধ তৈরি হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে অতি জোয়ার, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি কারণে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুকঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। কোনো কোনো প্রজাতি এখন বিলুপ্ত হবার পথে। সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে এখন দ্রুত বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, মোখা পরবর্তী সেন্টমার্টিনসহ উপকূলে সমুদ্রসৈকতের জন্য জিও টিউব এবং জিওব্যাগ দিয়ে এলাকায় ভাঙন অথবা পানি প্রবেশের রোধে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে গোটা সেন্টমার্টিনের চারপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ দেওয়া বা অন্যকোনো ব্যবস্থা নেওয়া উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মত বিষয়।

স্থানীয়রা জানায়, গত ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দ্বীপটিকে। ১২শ বাড়িঘর ভেঙে গেছে। মাদ্রাসামসজিদ ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ পাড়া, গলাচিপা ও উত্তর পাশের সমুদ্র সৈকত। এখন পুরো অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দ্বীপটি। সামান্য জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে দ্বীপের ভাঙন কবলিত এলাকা। জলোচ্ছ্বাস হলে রক্ষা পাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই কার্যকর নেই সৈকত এলাকায়। এতে দ্বীপের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান সেন্টমার্টিন ঘুরে গেছেন। এই সময় স্থানীয়রা পর্যটনবান্ধব ও টেকসই বেড়িবাঁধ দেওয়ার দাবি জানান। তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলবেন বলে নিশ্চিত করেন।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সেন্টমার্টিনে যেকোনো ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করেই গড়ে উঠছে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল। এছাড়া পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা, ভারী জেনারেটর, পাম্প পরিচালনা, পাথর তোলা, সৈকতের বালি অপসারণ, এক কথায় পরিবেশ বিধ্বংসী সব ধরনের কাজই হয় দ্বীপটিতে। এখন মোখা দ্বীপটিকে আরও নাজুক করে তুলেছে।

পরিবেশ অধিদফতর জানিয়েছে, অবৈধভাবে গড়ে উঠা সেন্টমার্টিনের স্থাপনা উচ্ছেদে তারা কয়েক দফা অভিযানে গিয়ে দেখে যে বেশিরভাগই আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালনা করছে। এ কারণে অধিদফতরও কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। অথচ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সরকার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাইসিএ ঘোষণা করেছিল।

পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিদিন যদি পর্যটকদের সংখ্যা সীমিত করে এক হাজার বা ১২শ জনের মধ্যে রাখা যায়, তাহলেও কিছুটা ভারসাম্য রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু সেখানে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন কমপক্ষে আট থেকে দশ হাজার পর্যটক ভিড় করছে।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার অফিসের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, পর্যটন মৌসুমে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেন্টমার্টিনে নিয়মিত অবস্থান করে এবং পরিবেশ রক্ষায় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করে।

জানা যায়, প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই দ্বীপটির স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। এছাড়া পর্যটক মিলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের চাপ নিয়ে এক প্রকার মৃতপ্রায় অবস্থা সেন্টমার্টিনের। এছাড়া সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে ছেঁড়াদিয়া দ্বীপও রয়েছে পরিবেশগত হুমকির মুখে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তিনি দ্বীপের ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিতভাবে অবহিত করেছেন বলেও জানান।

তবে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই দ্বীপে পর্যটকদের চলাচল পুরোপুরি বন্ধ না করলে দ্বীপের পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। এমন দাবির কথা বলেছেন টেকনাফ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ছৈয়দ হোছাইন। তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে সৈকত ও পানির নিচে যতো দূষণ হয়েছে সব পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়া দ্বীপের সব ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে হবে।

বছরের একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে শুধুমাত্র দিনের বেলা সীমিত সংখ্যক পর্যটককে যাতায়াত করতে দেয়া হলে দ্বীপটির পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা যাবে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। এ নিয়ে কয়েক দফা সেন্টমার্টিন দ্বীপ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হলেও একবারও তা কার্যকর হয়নি।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিদায়ী চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ বলেন, এমনিতেই নাজুক প্রবাল দ্বীপটি, এখন মোখা সেটিকে আরও বেশি অরক্ষিত করে তুলেছে। সেন্টমার্টিনকে বারবার মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা, পর্যটক সীমিতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা অদৃশ্য কারণে বাস্তবায়ন করা যায় না। তবে এখন বিষয়টি নিয়ে জোরালো ভাবে ভাববার সময় এসেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিকআপ নিয়ে গরু চুরি করতে এসে জনতার হাতে ধরা
পরবর্তী নিবন্ধগুপ্তছড়া ঘাটে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী