ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র হয় একটা দেশ দেখান : প্রধানমন্ত্রী

গুলশান-বারিধারায়ও লোডশেডিং দেয়ার নির্দেশ

| শুক্রবার , ১০ মে, ২০২৪ at ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

বিদ্যুৎ না কিনলেও যে কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়, তার সমালোচনার জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রশ্ন রেখেছেন বিশ্বের এমন কোন দেশ আছে যেখানে এমন বিধান ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়? গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এই প্রসঙ্গে কথা বলেন।

এর আগে বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জের কারণেই বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আর সেই ভর্তুকি সামাল দিতেই বার বার দাম বাড়াতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তার জবাবে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশ আছে যেখানে ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর হয়? একটা দেশ দেখান। এখন ক্যাপাসিটি চার্জ বলে চিৎকার। খবর বিডিনিউজের।

রেন্টালকুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ আইনের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, তারা প্রশ্ন উঠান, বিশেষ আইন কেন করলাম? বিশেষ আইন এ জন্য করেছি, আমি তো ব্যক্তিখাতে সব উন্মুক্ত করে দিয়েছি। ব্যক্তিখাতে উন্মুক্ত করে দিতে হলে আইন করেই করতে হবে। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা শুধু সরকার দিয়ে হবে না, ব্যক্তিখাত দিয়েই করতে হবে। ব্যক্তিখাত না দিলে কর্মসংস্থানও বাড়ে না।

বিশেষ আইনে কাউকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বরং বেসরকারি খাতে প্রথম বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছিল সামিট। খুলনায় তারা এ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেরি করেছিল। যে কয়দিন দেরি করেছিল প্রতিদিন ১০ হাজার ডলার করে জরিমানা দিতে হয়েছিল। সেই জরিমানা আমি আদায় করেছিলাম। ছাড় আমি দেই না, সেটা মাথায় রাখতে হবে। এখানে দায়মুক্তির কিছুই নেই মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন যাতে বন্ধ না হয় এ জন্য বিশেষ আইনটি করা হয়েছে। উন্নয়ন করতে হলে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ দেওয়া। বিদ্যুৎ দিতে পারলে কর্মসংস্থান এমনিই তৈরি হয়।

সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বহুমুখী করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সোলার প্যানেল শুরু করেছি। বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শুরু করেছি, কয়লাভিত্তিক করছি, তেলভিত্তিকগ্যাসভিত্তিক সবই করছি। মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে চাই। হ্যাঁ যে প্রচণ্ড গরম, সেখানে লোড শেডিং হয়েছে, আমরা সেটা স্বীকার করি। কিন্তু কৃষক যেন সেচ পায়সেখানে কিন্তু ভর্তুকি দেয়া হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী অভিজাত এলাকাতেও বিদ্যুতের লোডশেডিং দেওয়ার কথা বলেন। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন।

বিএনপির শাসনামলের সঙ্গে তার আমলের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির তুলনাও করেন প্রধানমন্ত্রী। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিএনপি আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্র ১৬ শ মেগাওয়াট ছিলএই কথাটিও জি এম কাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন যে হয়, এটা প্রথম উপলব্ধি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে।

শেখ হাসিনা কেবল বিদ্যুৎ খাত নয়, তার সরকারের আমলে উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে উঠা নানা সমালোচনারই জবাব দেন। কথা বলেন সড়ক অবকাঠামো খাতে উচ্চ নির্মাণ ব্যয় নিয়েও। তিনি বলেন, কেউ কেউ বলে বাংলাদেশে রাস্তা বানাতে এত খরচ কেন? এদের দেশের মাটি সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই। মাটির সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্কই নেই। আমাদের মাটি এটা একটা বদ্বীপ। এ মাটি দোআঁশলা, এ মাটি নরম। এখানে কোনো কিছু করতে গেলেওই যেনতেন করতে করতে গেলে দুচারদিনের বেশি থাকে না।

মাটি তুলে আধুনিক প্রযুক্তিতে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাস্তা যখন চড়েন দেখেন না? তো খরচ তো লাগবে। সেখানে শক্ত মাটি সেখানে অত খরচ হয় না। নরম মাটি বলেই খরচ বেশি। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছু নেই।

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তারা এখন লজ্জা পাচ্ছেন কি না, সেই প্রশ্নও রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, পদ্মায় রেল লাইন, এটার নাকি প্রয়োজনই নেই। এ রেল লাইন ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে মংলা পোর্ট পর্যন্ত পৌঁছাবে। সেইভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটা প্রয়োজন নেই যারা বলেন, তাদেরকে কী বলব অর্বাচীন ছাড়া? কেউ কেউ মেট্রোরেল নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এর কী প্রয়োজন ছিল? তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে তো যানজটমুক্ত হত। আজকে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার মানুষ মেট্রোরেল দিয়ে চলতে পারে। এটায় যারা চড়ছে তারা সুফল পাচ্ছে। যারা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলতারা লজ্জা পাচ্ছে কিনা জানি না।

রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে তিনি বলেন, এত টাকা খরচ করে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন করলাম? এটা কী প্রয়োজন ছিল? নিউক্লিয়ার পাওয়ার হচ্ছে সব থেকে ক্লাইমেট ফ্রেন্ডলি। কোনো দূষণ নেই। সেই ৬২ সাল থেকে এটা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানিরা আমাদের ধোঁকা দিয়েছিল। দুটি পাওয়ার প্লান্ট করবে বলে দুটোই নিয়ে গেল পাকিস্তানে। আজকে আমরা পারমাণবিক পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ করেছি। এখান থেকে সব থেকে ভালো বিদ্যুৎ আমরা পাব। আমরা সেখানে আরো একটা করব। ইতোমধ্যে আমি কথা বলেছি। ওখানেই আরেকটা হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে, এর আগে কোনো সরকার তা করতে পেরেছে কি না, সেই প্রশ্নও রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা ১৫ বছরে যে পরিমাণ কাজ করতে পেরেছি। ওই ২১ বছর আর ৮ বছর। এই ২৯ বছরে কেউ করতে পেরেছে? পারেনি। পারবেও না। প্রকল্প দিয়েই তো আগে টাকা খাওয়া। আর আমরা প্রজেক্ট শেষ করে ছাড়ি। টাকা খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাংক চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল। আমরা তা মোকাবিলা করেছি। প্রমাণ করতে পেরেছে?

জনগণের কাছ থেকে দূরে সরানো যাবে না বলেও সাফ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রধান। বলেছেন, দেশবাসী পাশে থাকলে কাউকে তিনি পরোয়া করেন না। শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের শক্তি নিয়ে আমি চলি। আমি তাদের জন্য কাজ করি। জনগণের মাঝে আস্থা তৈরি হয়েছে। ওই আস্থা ও বিশ্বাসই আমার একমাত্র সম্বল। এই সম্বল নিয়ে আমি চলি। এজন্য কাউকে পরোয়া করি না। যতক্ষণ আমার দেশবাসী পাশে আছেকাউকে পরোয়া করি না। সমালোচনা করে জনগণ থেকে আমাকে দূরে সরাতে পারবেন না।

বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে সংসদ নেত্রী বলেন, মানুষের কল্যাণে কী করণীয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করি। দেশের কল্যাণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভোগ করবেন সবাই আর কথায় কথায় ব্যঙ্গ করবেন আর প্রশ্ন তুলবেন, প্রশ্ন তোলার আগেনিজেরা কী করেছেন? কোন দল করেনসেই দলের বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে অপকর্মগুলো একটি চিন্তা করে নেবেন।

বঙ্গবন্ধুর আমলেও সমালোচনা হয়েছিল উল্লেখ করে জাতির পিতার কন্যা বলেন, আমার বাবার সঙ্গেও একেই জিনিস হয়েছে। কতগুলো কাজ তিনি করে গেছেন, তারপরও তার সমালোচনা। তার বিরুদ্ধে নানা কথা, নানা লেখা। অনেক কিছু করে তাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়েছে। যখন পারেনি, তখন হত্যা করা হয়েছে। আমাকে তো হত্যার জন্য বার বার চেষ্টা করা হয়েছে।

জিয়াউর রহমানের সময়ে দেশে এলিট শ্রেণি সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আজকে যে কথায় আসে ঋণ খেলাপি, এই সংস্কৃতি কখন শুরু হয়েছিল? ওই জিয়াউর রহমান যখন অবৈধ ক্ষমতা দখল করে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, সেই সময় থেকে। যার ধারাবাহিকতা আমরা দেখেছি এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে। সেখান থেকে এখনো পূর্ণ মুক্তি পাওয়া যায়নি। এটাই হল বাস্তবতা। তারপরও আমাদের প্রচেষ্টা আছে।

অনেকেই এখন গণতন্ত্রের প্রবক্তা হয়ে গেছে মন্তব্য বরে তিনি বলেন, জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার সংস্কৃতি জিয়াউর রহমানের আমল থেকে শুরু।

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে গ্যাস বিক্রির প্রস্তাবে রাজি হলে আওয়ামী লীগ ওই বছরও ক্ষমতায় আসত বলে আগের বহুবারের বলা বক্তব্য আবার তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বলেন, আমি তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, আমার পক্ষে দেশ বিক্রি সম্ভব না। সেই নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের উপর হামলার চিত্রও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এ তাণ্ডব তাদের চলে।

বিএনপির আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে এক নম্বর দেশ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের দেশে পরিণত হয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাহলে বিএনপি কেন মাত্র ৩০টি আসন পেল? তাহলে তারা এখন কীভাবে বলে নির্বাচনে আসবে না, নির্বাচন হয় না বা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে? জনগণ ভোট দেবে না জেনেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির কর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাড়ির দরজায় হামলা করেছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারা বিএনপির অভ্যাস আছে। সেটাও তারা করেছিল। সাংবাদিকদের খালি পেটানো না, প্রেসক্লাবে ঢুকে সাংবাদিকদের পিটিয়েছে, সেই রেকর্ডও আছে। অপকর্মের কোনো কিছুর বাদ নেই। তার জন্য আমার প্রশ্ন, নিজেদের আয়নায় চেহারা দেখা উচিত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের টিম গঠন
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন নিয়মিত চালুর প্রস্তাব