চট্টগ্রামে চার লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন একশ জন। বছরে চল্লিশ হাজারেরও বেশি নতুন রোগী যুক্ত হচ্ছে এই তালিকায়। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কিছু মানুষ চিকিৎসা নিতে এলেও অসংখ্য মানুষ রয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসার বাইরে। ক্যান্সার চিকিৎসার অপ্রতুলতায় বছরে বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর হার সাড়ে সাত শতাংশ। চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতি না ঘটলে ২০৩০ সালে এই হার ১৩ শতাংশে পেঁৗঁছাবে।
ক্যান্সার চিকিৎসার এই পরিস্থিতির মাঝে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল বিশ্বমানের একটি হাসপাতাল গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ক্যান্সারের চিকিৎসা এবং গবেষণায় ভূমিকা রাখার লক্ষ্য নিয়ে হাসপাতালটি গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালটির জন্য ভূমি এবং ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেই পুরোদমে কাজ শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামে ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি। এক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস বড় ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন ধরনের ভেজাল খাদ্য মানুষকে অতিমাত্রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত করছে। চট্টগ্রামের মানুষের শুটকিপ্রীতিও এক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে।
তারা বলেন, দেশে বর্তমানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর মধ্যে বৃহত্তর চট্টগ্রামে অন্তত ৫ লাখ মানুষ ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করছেন। প্রতিদিন শত শত মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছেন। চট্টগ্রামে ক্যান্সারের প্রকোপ এবং ঝুঁকি বেশি হলেও চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও চিকিৎসার সুযোগ নেই বললেই চলে। বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা চেম্বার করলেও মূলত কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। রেডিওথেরাপির জন্য চমেক হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হয়। চমেক হাসপাতালে রেডিওথেরাপির যে মেশিন রয়েছে ওই ধরনের মেশিন উন্নত বিশ্বে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আধুনিক মেশিনে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডাসহ উন্নত দেশগুলোতে। দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে রেডিওথেরাপির কোনো সুযোগ না থাকলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রচুর লোক চমেক হাসপাতাল থেকে এই সুবিধা পেয়েছেন।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ গতকাল আজাদীকে জানান, চমেক হাসপাতালে প্রতিদিন প্রচুর রোগী আসেন। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। রেডিওথেরাপির মেশিন চালু রয়েছে। এই মেশিনটি ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মেডিকেল অংকোলজি ও রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান ডা. শেফাতুজ্জাহান আজাদীকে বলেন, ক্যান্সারের ভয়াবহ অবস্থা চট্টগ্রামে। প্রতিদিনই প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বহু মানুষই চিকিৎসা সুবিধার বাইরে রয়েছে। চমেক হাসপাতাল বা মা ও শিশু হাসপাতালে আমরা যেভাবে চিকিৎসা দিচ্ছি তা পর্যাপ্ত নয়। বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার আওতায় আনা, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়, সেবার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ও ক্যান্সার চিকিৎসায় বিদেশ নির্ভরতা কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া সরকারের এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
মা ও শিশু হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির ট্রেজারার রেজাউল করিম আজাদ বলেন, চট্টগ্রামে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশ্বমানের একটি হাসপাতালের অভাব ঘুচাতে কয়েক বছর আগে আমরা উদ্যোগ নিই। ইতোমধ্যে বেশ অগ্রসর হয়েছি। চট্টগ্রাম মা-শিশু হাসপাতালে ‘সিএমওএসএইচ ক্যান্সার হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ নামের এই প্রতিষ্ঠানের জন্য দশ কাঠা জায়গা তৈরি করেছি। এর মধ্যে আট কাঠা জায়গা সরকার ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য দিয়েছে। বাকি দুই কাঠা জায়গাও সরকারের কাছ থেকে ইতোপূর্বে পাওয়া স্থান থেকে নেওয়া হয়েছে। দশ কাঠায় দশ তলা ভবনের প্রয়োজনীয় সব অনুমোদন পাওয়া গেছে। পারমাণবিক শক্তি কমিশন এবং পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদনও পাওয়া গেছে। দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে প্রধান করে ১০১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ক্যান্সার হাসপাতালের ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করছে।
ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব রেজাউল করিম আজাদ বলেন, ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয় অর্থ আমাদের হাতে জমা হয়েছে। রেডিওথেরাপি মেশিনসহ ক্যান্সার চিকিৎসার বিশ্বমানের সব যন্ত্রপাতি সংগ্রহের ব্যাপারেও লন্ডনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছি। তারা আমাদেরকে পাঁচ বছরের কিস্তিতে সব যন্ত্রপাতি যোগান দিয়ে হাসপাতাল চালু করে দেবে। আমরা আয় থেকে কিস্তিতে ওই টাকা পরিশোধ করব।
তিনি বলেন, যত দ্রুত ভবনটি নির্মাণ করতে পারব তত দ্রুত হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হবে। আমাদের দশ হাজারেরও বেশি আজীবন সদস্য চাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাসপাতাল ভবনের ভিত্তি স্থাপন করুন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি ভার্চ্যুয়াল আয়োজনে যুক্ত হয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তাহলে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করব। ৫৫ হাজার বর্গফুটের ভবনটি নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারলে দুই বছরের মধ্যে হাসপাতাল চালু করে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষকে বিশ্বমানের সেবা দেয়া সম্ভব হবে।