কোয়ান্টাম (Quantam) মানে পরিমাণ। প্রকৃত অর্থে প্রয়োজনীয় বা অনুমোদিত পরিমাণ। এখানে ‘কোয়ান্টাম’ একটি জীবন পরিচালনার পদ্ধতির নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘কোয়ান্টাম মেথড’ মানে ‘জীবন যাপনের একটি অনুমোদিত পদ্ধতি’ বলা যেতে পারে। এটাকে জীবন যাপনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিরূপেও প্রকাশ করা হয়।
কোয়ান্টাম মেথড বা কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশন এর জন্ম ১৯৯৩ সালে। প্রণেতা ও প্রতিষ্ঠাতা শহীদ আল বোখারী। একান্ত সহযোগী হিসেবে আছেন মাদাম নাহার আল বোখারী। কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যদের নিকট শহীদ আল বোখারী ‘গুরুজী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি প্রথম জীবনে সাংবাদিকতা করেছেন। এক সময় জ্যোতির্বিদ্যা এবং নিউমারোলজির উপর গবেষণা শুরু করে আবির্ভূত হন মহাজাতক হিসেবে। এই বিষয়ে তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করে দেশের এলিট সমাজে সমাদৃতি লাভ করেন। মানুষের সুখ দুঃখের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন – মানুষ তার নিজের ভাগ্য আংশিক হলেও নির্ণয় করতে পারে এবং তার পরিবর্তন ঘটাতেও পারে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, “জনাব শহীদ আল বোখারী এক সময় হাতের রেখা ধরে মানুষের ভবিষ্যত রোড ম্যাপ তৈরী করে দিতেন। সেই সুবাদে তাঁর সাথে আমার সখ্যতা ও ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু, এক সময় তিনি নিজের মত করে বদলে গেলেন। তিনি বুঝলেন মানুষের এই রোড ম্যাপ তো মানুষ নিজেই তৈরী করতে পারে, যদি তাকে প্রকৃত মানের মানুষরূপে গড়ে তোলা যায়। সমাজে তাঁর এই বোধের প্রতিফলন ঘটানোর উপায় বের করার জন্য তিনি সাধনায় নিমগ্ন হলেন এবং আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে ১৯৯৩ সালে জনসমক্ষে ‘কোয়ান্টাম মেথড’ নামক জীবন পদ্ধতি নিয়ে হাজির হলেন”। আবির্ভাবের প্রথম দিন বা উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম। সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত ‘শিথিলায়ন মেডিটেশন’ ছাড়াও আত্ম উন্নয়নমূলক নানাবিধ বিষয়ের উপর এ যাবৎ ৬৫টি মেডিটেশন ক্যাসেট বা সিডি সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হয়।
‘কোয়ান্টাম মেথড’ এর প্রথম ধাপের কোর্সকে ‘ফাউণ্ডেশন কোর্স’ বলা হয়। উপর্যুপরি চারদিন এবং প্রতিদিন প্রায় দশ ঘন্টা করে গুরুজীর অনবদ্য এই ভাষণ ও নির্দেশনামূলক কথা দিয়েই এই কোর্স। এবং এর মাধ্যমে মানুষকে তার নিজের ভিতর লুকিয়ে থাকা অফুরন্ত প্রাণশক্তির সন্ধান লাভ, মিতব্যয়িতা ও আত্মতুষ্টির সহজ কৌশল, হতাশামুক্ত প্রত্যয়ী, বদভ্যাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি লাভের উপায়, নান্দনিক পন্থায় আচরণভঙ্গি ও স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসে অটল থাকার সহজ ও সাবলীল নির্দেশিকা প্রদান করে আসছেন। এ যাবৎ ফাউণ্ডেশন কোর্সের ৪৭০টি কোর্স সফলভাবে সমাপ্ত করা হয়েছে।
বিভিন্ন সময় কোর্সে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন দেশবরেণ্য বিজ্ঞজনের মন্তব্য নিম্নরূপ-
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম বলেন,“কোয়ান্টাম মেথড আধুনিক চিকিৎসার পরিপূরক। আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি কোয়ান্টাম মেথড অনুযায়ী মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমে রোগমুক্তি ও প্রশান্তি অর্জন সহজ হবে। কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ – রোগমুক্তি ও নিরাময়ের বিচিত্র অনুভূতিগুলো সংকলিত করে আপনারা বই আকারে প্রকাশ করুন। এর মাধ্যমে চতুর্দিকের মানুষ ব্যাপক হারে উপকৃত হবে”। বর্তমানে তাঁর এই পরামর্শ বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম বলেন – “সুস্বাস্থ্য নিয়ে আদর্শ ও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির জীবন গড়ার জন্য কোয়ান্টামের শিক্ষা সমূহ যথেষ্ট গ্রহণ যোগ্যতা রাখে। বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেথড এর অনুসারীরা বিশ্ব মানব সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে”।
জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) ডাঃ আবদুল মালিক বলেন,“শরীরের উপর মনের প্রভাব অপরিসীম। তাই শরীরকে যেমন সুস্থ রাখতে হবে মনকেও রাখতে হবে সুস্থ। অস্থির মনকে সুস্থ ও কল্যাণের পথে আনতে মেডিটেশনের বিকল্প নাই। কোয়ান্টাম মেডিটেশনের চমৎকার সহজ রূপ আবিষ্কার করেছে এবং তা সর্বজনীন কল্যাণে ব্যবহারের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে”।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ এর মন্তব্য – “অসংখ্য মানুষের নিরাময় ও সাফল্য দেখে আমার মনে হয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন অগণিত কৃতজ্ঞ মানুষের একটি সংঘ। মেডিটেশন করে আমার জীবনিশক্তি বেড়েছে। আমি আগের চেয়ে সজীব ও সতেজ হয়ে উঠেছি”।
বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক অধ্যাপক ড. মইনুদ্দিন আহমদ খান বলেন,“কোয়ান্টামের বিভিন্ন প্রকাশনা পড়ে আমার ধারণা হল যে, কোয়ান্টাম বলে – নিজের জ্ঞানটা নিজেকে আত্মস্থ করতে হবে; অনুভূতি বা চিন্তার উন্নতি ঘটাতে হবে; আর চিন্তাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। এ কাজগুলো সহজভাবে করার জন্য কোয়ান্টাম মেথড একটি ভাল পদ্ধতি”।
প্রখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী ড. এম শমসের আলীর মতে, “ধ্যান আত্মবিশ্বাসকে আসাধারণভাবে জাগিয়ে তোলে। মেডিটেশন মানুষের শারীরিক ও মানসিক জাগরণের প্রধান উপায়। তাই মেডিটেশনের গুরুত্ব অপরিসীম। কোয়ান্টাম মেথড আজকের মানব সমাজকে মেডিটেশনের সহজ ও কার্যকর পন্থা উপহার দিয়েছে”।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন,“বিশ্বাস, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সততার স্ফুরণ ঘটাতে পারলে এ দেশের সামনে অপেক্ষমান অভাবনীয় সফলতার দ্বার শীঘ্রই উম্মোচিত হবে। সকল প্রকার জাতিগত হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্ন দেখার প্রক্রিয়া কোয়ান্টাম ইতিমধ্যেই শুরু করেছে। এটা জাতির জন্য খুবই ইতিবাচক দিক”।
মাননীয় শুদ্ধানন্দ মহাথেরো মন্তব্য করেন,“ মন হল সকল কর্মের চালক। আর এই মনের শুদ্ধ ও ঋদ্ধির জন্যই ধ্যান। প্রজ্ঞা ছাড়া ধ্যান হয় না, আর ধ্যান ছাড়া প্রজ্ঞা সৃষ্টি হয় না। একজন ধ্যানী মানুষ কখনও অন্যায় করতে পারে না। কোয়ান্টাম সেই ধ্যান বা মেডিটেশনের কথা বলে, প্রাত্যহিক জীবনের মানোন্নয়নে সঠিক তথ্য নির্দেশ করে”।
শ্রদ্ধেয় গুরুজী শহীদ আল বোখারী কর্তৃক পরিচালিত চারদিন ব্যাপী কোর্সে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একজন মানুষ নিজেকে ভালভাবে জানতে পারে এবং নিজের ভিতর সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত শক্তি ও ক্ষমতার সন্ধান লাভে সমর্থ হন। এ ছাড়াও বিজ্ঞান ভিত্তিক জীবন যাপনে নিজেকে অভ্যস্থ করে তোলা, ক্ষণিকের ধ্যানের মাধ্যমে উপলব্ধির চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছা, জন্ম থেকেই অর্জিত অফুরন্ত শক্তির সন্ধান লাভ, মনই সকল শক্তির উৎস – এর উপলব্ধি, দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর মাধ্যমে নিজেকে বদলে দেয়া, অভাবকে প্রাচুর্যে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া, শরীরকে সব সময় কর্মোপযোগী রাখার উপায়, প্রথাগত অবিদ্যা ও কুসংস্কার চিহ্নিত করন ও বর্জনের শিক্ষা, আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার চমৎকার কৌশল, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে নিশ্চিত অগ্রযাত্রার কৌশল, নিজের অর্জিত সম্পদ ও পদবী নিয়ে পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকার কৌশল, অন্যকে একাত্ম করার কৌশল, শরীরে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি, যে কোন কিছুতে বা লিখা পড়ায় মনোযোগী হওয়ার অনন্য কৌশল, ধ্যানের স্তরে গিয়ে নিজেকে বা অন্যকে নিরাময় করার কৌশল, সংযমী মিতব্যয়ী ধৈর্যশীল ও সদা উৎফুল্ল থাকার এবং সুনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের কৌশল ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হয়।
সূচনালগ্নে মেডিটেশন শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করা ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ বর্তমানে নানাবিধ মানবিক কাজে ব্যাপৃত হয়েছে। এরমধ্যে দেশব্যাপী স্ব-উদ্যোগে রক্ত প্রদানকারীদেরকে নিয়ে ভ্রাম্যমান ব্লাডব্যাংক, ঢাকায় অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরীসহ স্থায়ী ব্লাডব্যাংক, বান্দরবানের লামায় দুঃস্থ শিশুদের জন্য থাকা খাওয়া সহ সর্বব্যবস্থা সম্বলিত কোয়ান্টাম শিশুকানন, রাজশাহীতে অভিভাবকহীন শিশুদের জন্য শিশুসদন, দেশব্যাপী স্বেচ্ছা লাশ-দাফন কর্যক্রম, দুর্গত পল্লীতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা, সিলেটে কর্মোদ্যোগী দুস্থ মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্র, সারা দেশে বিনামূল্যে খত্না করণের ভ্রাম্যমান ক্যাম্প পরিচালনা, গরীব গর্ভবতী মহিলাদের জন্য মাতৃমঙ্গল কার্যক্রম, দেশের সিনিয়র কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরিচালিত কোয়ান্টাম হার্টক্লাব প্রতিষ্ঠা সহ নানাবিধ আত্মিক মানবিক শারীরিক সর্বোপরি সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়াও কোয়ান্টামের অন্যতম প্রকাশনা ‘শুদ্ধাচার’ বইটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তির জন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা বিভাগ নির্দেশ জারী করেছে।
এক কথায় -বিদ্যমান সামাজিক অস্থিরতা ডিঙ্গিয়ে একটি সুস্থ সুনিয়ন্ত্রিত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ অগ্রসর হচ্ছে ভবিষ্যতের দিক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজব্রতী