কোরআন বুঝে পড়ার গুরুত্ব

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

মহাবিশ্বের একমাত্র মহানিয়ন্ত্রক, আসমান-জমিনের একচ্ছত্র অধিপতি আমার আল্লাহতায়ালা। পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতির জন্যে মানবজীবনের সার্বিক পূর্ণ সমাধানসহ যে হেদায়াত গ্রন্থ পাঠিয়েছেন তা হচ্ছে পবিত্র কুরআনুল করিম। এই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহতায়ালার প্রিয় হাবিব, সায়্যিদানা মুরসালিন, খাতেবুন নাবিয়্যিন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর ১৫০০ বছর আগে। এই সত্য কিতাবটি এসেছে কিয়ামত অবধি সমগ্র মানবজাতির জন্য, ‘আর এ কোরআন হচ্ছে) মানবজাতির জন্যে পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী’- সূরা বাকারা- ১৮৫। মহান আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারার ২ নং আয়াতে বলেছেন, ‘(এই) সেই (মহা) গ্রন্থ (আল কোরআন), তাতে (কোনো) সন্দেহ নেই, যারা (আল্লাহ তায়ালাকে) ভয় করে (এই কিতাব কেবল) তাদের জন্যেই পথপ্রদর্শক’। আল্লাহতায়ালা এই কোরআনকে আমার রাসূল (সাঃ) এর নবুয়তি জীবনের ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে নাযিল করেছেন মহান আরশে আজিম থেকে-যেটি সংরক্ষিত রয়েছে এক মহাফলকে- যার নাম লাওহে মাহফুজ। ‘এটি লিপিবদ্ধ রয়েছে একটি রক্ষিত গ্রন্থে। এই কোরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এখানে নিহিত রয়েছে মানব জীবনের সম্পূর্ণ সমাধান। এটির প্রতি হরফ পঠনে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া যাবে ১০ নেকি আর তা বুঝে পড়লে সওয়াব এর মাত্রাও যেমন বেড়ে যাবে তেমনি সামগ্রিক জীবনের সম্পূর্ণ সমাধান যে এই কুরআনেই লিপিবদ্ধ রয়েছে তা পুংখানুপুংখভাবে বোঝা যাবে ও জানা যাবে। অতএব প্রত্যেক মুসলমানের উপর এই কোরআন জানা ও বুঝা ফরজ। যেহেতু আমরা এই কুরআনের উপর ঈমান এনেছি। আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো সমস্ত আসমানি কিতাব (তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর, সহিফা ইত্যাদি) বিকৃত হয়েছে বারবার। যে জাতিগুলোর উপর এই কিতাবসমূহ অবতীর্ণ হয়েছে তারাই এই কিতাবকে কাঁটা-ছেড়া করে বিতর্কিত করে ফেলেছে। অতএব, এই মানবজাতির জন্য এখন একমাত্র ভরসা আগামী কেয়ামত অবধি আল্‌-কোরআন, আল্‌ কোরআন এবং আল্‌ কোরআন। এই কোরআনের উপর ফি বছর যুলুম করে যাচ্ছি আমরা। পিতা-মাতা কিংবা আত্নীয়-স্বজন মারা গেলে শুধুমাত্র এই কোরআন পাঠ করার জন্য বসে যাই কিংবা পবিত্র রমজান মাসে কোরআন খতমের হিড়িক পড়ে যায়। শুধুমাত্র তেলওয়াত কিংবা ক্বেরাত প্রতিযোগিতার জন্য উঠে পড়ে লাগি। এই কোরআন শুধুমাত্র আসেনি পঠনের জন্য, কথনের জন্য, ইছালে সওয়াবের জন্য, রমজানে খতম করার জন্য, ক্বেরাত প্রতিযোগিতা করার জন্য। এটি এসেছে আল্লাহর এই জমিনের উপর কোরআনের বিধান প্রতিষ্ঠার জন্যে এক মহান মিশন নিয়ে। এই কোরআনে রয়েছে মানবজীবনের এক বিশাল পূর্ণাঙ্গ অভিধান। তাইতো আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাবে তাঁর কালামে পাকে বলছেন, ‘এরা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে না?’- সূরা আন নেসা-৮২। অন্য এক আয়াতে বলছেন, ‘নিসন্দেহে এ (কোরআন) হচ্ছে তোমার ও তোমার জাতির জন্যে উপদেশ, অচিরেই তোমাদের (এ সম্পর্কে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’- সূরা আয্‌ যোখরূফ- ৪৪। আল্লাহতায়ালা আরও বলছেন, ‘তবে কি এরা কোরআন সম্পর্কে গবেষণা করে না! না কি এদের অন্তরসমূহের উপর তালা (ঝুলে) আছে’- সূরা মোহাম্মদ-২৪। অতএব এটির গবেষণা কিংবা চর্চা করার দায়িত্ব আমার- আপনার- সবার। এই ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেই দিয়েছেন আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এটি শুধু বিশেষ গোষ্ঠী কিংবা জাতির জন্য আসেনি কিংবা আলেম ওলামা ও হাফেজদের জন্য আসেনি। বাজারে প্রচুর সহীহ তাফসির গ্রন্থ রয়েছে- যেমন: তাফসির ইব্‌নে কাসির, মা’রেফুল কোরআন, ফি জিলালিল কোরআন ইত্যাদি। সেই তাফসির গ্রন্থ থেকে আল কোরআনের প্রতিটি আয়াত আমরা বুঝার চেষ্টা করব। সাথে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর বিশুদ্ধ সনদের হাদিসগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করব। আর এরপরও যদি না বুঝি তাহলে আমরা বিদগ্ধ ও হক্কানি আলেমগণের শরণাপন্ন হব। কারণ উনাদের জ্ঞানের গভীরতা আমরা আমামদের চেয়ে অনেক। উনারা আমাদের মহান শিক্ষক। এই কোরআনে রয়েছে তাওহীদ, রেসালত, তাকদীর, কেয়ামত, ফেরেশতা, পবিত্রতা, নামাজের হুকুম, যাকাত, রোজা ও হজ্বের বিধান, নারী ও পারিবারিক জীবন, দন্ডবিধি, ইসলামের অর্থনীতি, ইসলামের রাষ্ট্রনীতি, ইসলামের সমাজনীতি, জেহাদের হুকুম সম্পর্কিত বিধান, বান্দার হক, আদব-কায়দা, হালাল ও হারামের বিধান, মুমিনের গুণাবলী, মোনাফেকের পরিচয় ইত্যাদি। তাহলে আপনি যদি কোরআন বুঝে সরল অনুবাদ ও ব্যাখ্যাসহ না পড়েন কিংবা চর্চা না করেন তবে আল্লাহ প্রদত্ত উপরোক্ত বিধানসমূহ নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? সুদ সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে। তালাকের বিধান সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে। এটির মোটামোটি ধারণা থাকলে হক্কানি আলেম-ওলামাগণ যে ভাষণ ওয়াজ মাহফিলে দিয়ে থাকেন তা বুঝতে আপনার খুব একটা কষ্ট হবে না। আর যদি আপনি কোরআনের অর্থসহ ব্যাখ্যা না বুঝে পড়েন তাহলে ওয়াজ নসীহত আপনার কাছে দুর্বোধ্য মনে হবে। তবেই তো হক কথা বলার পক্ষে অবস্থানকারী আলেমদের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষিত সমাজ একদিন এই কোরআনকে মসজিদ থেকে বের করে এনে মহান সংসদে প্রতিস্থাপন করবেন, বিচারকার্যে কোরআনের বিধান অনুযায়ী চালু করার ঘোষণা দিবেন-যদি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলগণ আল কোরআনকে একমাত্র সত্য কিতাব হিসাবে মেনে নেন। আপনি লাখো কোটি ওয়াজ নসিহত করে এবং দেশের সাড়ে তিন লক্ষ মসজিদ থেকে আওয়াজ তোলে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করা সুদূর পরাহত-বোকার স্বর্গে বাস করা বৈ কিছুই নয়। আল্লাহর এই বিধান কোরআনকে তাঁর জমিনে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ফিকির কিংবা মেহনত না করার কারণে কাল কেয়ামতের কঠিন ময়দানে মহান রাব্বুল ইজ্জতের কাছে শুধু আলেম-ওলামা-হাফেজ নয়, সাধারণ শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমাজ, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনবেন আমার আল্লাহতায়ালা- এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ মানুষের রচিত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আল্লাহতায়ালা অনুমতি দেননি। এই পৃথিবীর সব রাষ্ট্র পরিচালিত হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সত্য কিতাবের বিধান অনুযায়ী। আর সেজন্যেই যুগে যুগে আল্লাহতায়ালা নবী রাসূলগণদের পাঠিয়েছেন, ‘তিনিই হচ্ছেন মহান সত্তা, যিনি তাঁর রাসূল (সাঃ) কে (যথার্থ) পথনির্দেশ ও সঠিক জীবনবিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে করে তিনি (দুনিয়ার) অন্য সব বিধানের ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, (সত্যের পক্ষে) সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট’- সূরা আল ফাতাহ্‌-২৮। অতএব এই আয়াত থেকে বোঝা যায় আল্লাহর কাছে কোন ধর্ম, কোন বর্ণ, কোন মতবাদ (সমাজবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, কমিউনিউজম, গণতন্ত্র) গৃহিত হবে না। আর সেই মতাবাদের অনুসারীরা চাইবে এই দ্বীনকে নিভিয়ে দিতে, ‘এ লোকেরা তাদের মুখের ফুৎকারেই আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়; অথচ আল্লাহ তাঁর এ নূর পরিপূর্ণ করে দিতে চান; কাফেররা তাকে যতোই অপছন্দ করুক না কেন’-সূরা আস্‌ সাফ- ০৮। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের দায়িত্বশীলগণ যদি কোরআনের প্রত্যেকটি বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন তাহলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, ছিনতাই, লুটতরাজ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ইভটিজিং, জমি দখল, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান দখল, বাক স্বাধীনতা হরণ, যেনা ব্যভিচার সব কিছুই নিমিষেই বন্ধ হয়ে যেত। অথচ কপাল পোড়া বিশ্বের এই মূর্খ জাতি আমরা-এই সত্য কিতাবের কোন বর্ণই আমরা অনুসরণ করছি না আজ। এই জন্যেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে জাহান্নামের কঠিন আগুনের জন্যে। যে বিচারক আল্লাহ প্রদত্ত বিচারের বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করেন না তাদের জন্য ভয়াবহ আয়াত নাযিল করেছেন, ‘যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করেন না, তারাই (হচ্ছে) কাফের’- সূরা মায়েদাহ-৪৪। এই সূরার ৪৫ এবং ৪৭ নং আয়াতেও আল্লাহর আইন অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করেন না তাদেরকে যথাক্রমে জালেম ও ফাসেক হিসাবে আল্লাহতায়ালা আখ্যা দিয়েছেন। তাহলে এই পৃথিবীর বিচারকরা আল্লাহর বিধান ব্যতিরেকে মানুষের রচিত বিধান দিয়ে যে রায়গুলো দিচ্ছেন সেগুলোর ব্যাপারে কাল কঠিন কিয়ামতের দিন আমার আল্লাহতায়ালা জিজ্ঞেস করলে কি জবাব দিবেন? হয়ত জবাব আসবে- হে আল্লাহ, ইসলামী রাষ্ট্র নেই বলেই আমরা সেটি করতে অসমর্থ হয়েছি। তখন যদি আল্লাহ তায়ালা বলেন- ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের জন্য কতটুকু ফিকির কিংবা মেহনত করেছো? তখন বিচারকগণের মুখ থেকে কোন কথা আসবে না। কারণ আল্লাহর এই আয়াত অকাট্য দলিল। এটি মানা আমাদের সবার জন্য ফরজ। আর যারা সম্মানিত আলেম ওলামারা সাধারণ শিক্ষিত সমাজকে কোরআন বুঝে পড়া ও ব্যাখ্যা করাকে নিরুসাহিত করেন তারা কি সেই মহাবিচারের দিন আমার বিচারের ভার কাঁধে তুলে নিবেন? তখন তো সবাই উলঙ্গ অবস্থায় ইয়া নাফ্‌সি, ইয়া নাফ্‌সি বলে নিজের আমলের ঘাটতির জন্য হায় হায় করতে থাকবে। তখন তো এই কোরানই আমাকে রক্ষা করবে। ধিক সেই গুটি কয়েক পথভ্রষ্ট আলেম- যারা আমরা সাধারণ মানুষ- যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা সভা-সমাবেশে আল্লাহর কোরআনের আয়াত বলি এবং তা অনুবাদ করার চেষ্টা করি, তারা উপহাস করে থাকেন। আমরা তো আগেই বলেছি কোরআনের যে বিষয়টি আমাদের দুর্বোধ্য সেটা খোলাসা করার জন্য সুদক্ষ আলেমগণের কাছেই তো যাব।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনুভূতিহীন
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা