কোরআন তেলাওয়াতের মর্যাদা; একটি বিশ্লেষণ

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য প্রেরিত মহাবিশ্বের মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অদ্বিতীয়, অনুপম, অসাধারণ বৈশিষ্ট্য, মাহাত্ন্য ও শ্রেষ্ঠত্বের গুণাবলীতে সমৃদ্ধ। এজন্যেই আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) কোরআন পাঠ ও চর্চার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কোরআন পাঠ-চর্চা কর। কারণ যে হৃদয়ে কোরআন বহন-ধারণ-আত্নস্থ করে, তাকে আল্লাহতায়ালা শাস্তি দিবেন না। ‘এই কোরআন হলো আল্লাহর আতিথ্য-আপ্যায়ন। অতএব, যে তা গ্রহণ করল-সে নিরাপত্তা লাভ করল। আর যে কোরআনকে ভালবাসলো, সু-সংবাদ তার জন্য অবধারিত’।

সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, ‘যে ব্যক্তি কোরআন অধ্যয়ন করে এবং কোরআনের বিশেষজ্ঞ হয়, সে কেয়ামতের দিন অনুগত সম্ভ্রান্ত ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করে এবং তা পড়তে পড়তে আটকে যায়, আর তা পড়া তার জন্য কঠিন হয়, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব’। অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে, ‘যে মুমিন ব্যক্তি কোরআন পড়ে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কমলালেবু। তার খুশবো মনোরম এবং স্বাদ চমৎকার। আর যে মুমিন ব্যক্তি কোরআন পড়ে না, সে খোরমার মতো। তাতে খুশবো নেই, কিন্তু তার স্বাদ মিঠা।

যে মোনাফেক কোরআন পড়ে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে রাইহান ফুল। খুশবো তার মনোরম কিন্তু স্বাদ তিক্ত। আর যে মোনাফেক কোরআন পড়ে না সে মাকাল ফলের মতো। তাতে কোনো খুশবো নেই এবং তার স্বাদও তিক্ত’-(বুখারী,মুসলিম)। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করে, সে তার বদলে একটি নেকি পায়। আর একটি নেকি দশটি নেকির সমান’। আমি ‘আলিফ-লাম-মিম কে একটি হরফ বলছি না: বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মিম একটি হরফ’- (তিরমিযি)। ‘ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত-রাসূলে কারীম (সাঃ) ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রামাদান মাসে তার এ দানশীলতার পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পেত যখন জিব্রাইল (আঃ) তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতেন।

জিব্রাইল (আঃ) রামাদানের প্রতিদিন রাসূল (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং রাসূল (সাঃ)কে নিয়ে বিগত রামাদান থেকে এই রামাদান পর্যন্ত কুরআনের যে পরিমাণ অংশ অবতীর্ণ হয়েছে, তা বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা ও চর্চা করতেন। এ সময় রাসূল (সাঃ) এর দানশীলতার গতি প্রবাহমান বায়ুপ্রবাহের চেয়েও অধিক গতিশীল থাকত-(বুখারী, মুসলিম)। যে বৎসর রাসূল (সাঃ) ইন্তেকাল করেন, সে বৎসর হযরত জিব্রাইল (আঃ) রাসূল (সাঃ) এর সাথে পূর্ণ কুরআন দু’বার আদ্যোপান্ত পর্যালোচনা-চর্চা করেন’- (বুখারী)। এ হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী পন্ডিতগণ বলছেন: প্রতি রামাদানে এক বা একাধিকবার পূর্ণ কুরআন পাঠ করা মুস্তাহাব। বরং প্রতি মাসে একবার পূর্ণ কুরআন পাঠ করা সুন্নাত। আর যদি সম্ভব হয় তাহলে প্রত্যেক সপ্তাহে একবার কিংবা প্রত্যেক তিনদিনে একবার।

এ সবগুলোই রাসূল (সাঃ) থেকে প্রমাণিত হয়েছে। এজন্যই আমাদের পুণ্যবান পূর্বপুরুষগণ রামাদানে কুরআন তেলাওয়াত করার জন্য তাদের সময়ের একটা বিরাট অংশ বরাদ্দ করে নিতেন। ইমাম যুহরী (রাঃ) রামাদান আসলে বাকি সব কাজ বন্ধ করে দিতেন। তিনি শিক্ষা দান, ফাতওয়া ও লোকজনের সাথে বসা বন্ধ করে দিয়ে বলতেন, এটা হচ্ছে কুরআনের মাস। সিয়াম পালনের সাথে কুরআনের সঙ্গে যেন সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই মাসে, এ কারণেই বিশ রাকা’আত তারাবীহর নামাযে সারা মাসে কমপক্ষে একবার কুরআন খতম করা সুন্নত করে দেয়া হয়েছে। কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন অনুধাবন ও তদানুযায়ী আমলের মাধ্যমে যারা এই মাসে কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, তারা বড়ই সৌভাগ্যবান। কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে কতগুলো মৌলিক উপাদান লক্ষ্য রাখতে হবে।

অন্যথায় তেলাওয়াত হবে তাৎপর্যহীন ও অর্থশূূন্য। সেই উপাদানগুলো হল: ১। বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও পঠনরীতি অনুসরণ: হযরত জিব্রাইল (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে যে পঠন ও উচ্চারণ পদ্ধতি সহকারে রাসূলে কারীম (সাঃ) কে কোরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং যে পদ্ধতি রাসূল (সাঃ) সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন সেই বিশুদ্ধরীতি অবলম্বন করে কোরআন পাঠ করতে হবে। এই পদ্ধতিতে কোরআনে তারতিল নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন আল্লাহর কিতাবের মধ্যে উচ্চারণগত বিকৃতি, ভুলত্রুটি থেকে রসনাকে সংরক্ষণ করা হয়, অন্যদিকে পঠন পদ্ধতিতেও কোরআনের স্বাতন্ত্র্যও প্রমাণিত হয়।

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন: এবং কোরআনকে তারতিলের সাথে তথা ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেছি’- আল ফোরকান-৩২। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর কোরআন আবৃত্তি কর তারতিলের সাথে অর্থাৎ ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে’- সূরা মুজ্জাম্মিল-৪। মহান আল্লাহতায়ালা ঐভাবে কোরআনের তেলাওয়াত পছন্দ করেন, যেভাবে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে’- (ইবনু খুযাইমা) । অন্য এক হাদীসে আরো রয়েছে, ‘রাসূলে কারীম (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশে উবাই বিন কা’বকে কোরআন পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। উদ্দেশ্যে ছিল, ‘তাকে শিক্ষা দেওয়া এবং কিভাবে কোরআন পাঠ করবে তা জানিয়ে দেওয়া’।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলতেন, ‘তারতিলের সাথে একটি সূরা পাঠ করা আমার কাছে পূর্ণ কোরআন পাঠ করার চেয়েও শ্রেয়’। অতএব আমাদের প্রত্যেককে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। এই কোরআন তেলওয়াতের মধ্যেই রয়েছে অবারিত সুখ আর আনন্দ-যা অবগাহন করে কোরআন পাঠকারী আজীবন আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য পেতে চেষ্টা করে। এই কোরআন তেলাওয়াতে মুমিন ব্যক্তির ঈমান বৃদ্ধি পায়।

লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধচোখের জল মানে না বাঁধ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা