কোভিড পরবর্তী ডিজেলের দাম বৃদ্ধি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

এম. নাসিরুল হক | সোমবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ভাষায় একটি কথা আছে “পাঠা উতার ঘষাঘষি মরিচের খারাবি”। বর্তমানে তেলের দাম বৃদ্ধি যে সেরকমই। গত সপ্তাহে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করেছে লিটার প্রতি ১৫ টাকা। মন্ত্রী বলেছেন দাম বৃদ্ধি নয়, সমন্বয় করা হয়েছে। এটাও “লটকিয়ে রাখা বা ঝুলিয়ে” রাখার মত বক্তব্য। আসল কথা হচ্ছে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বেড়েছে, এর ফায়দা লুটছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ির মালিকেরা এবং এর নিচে চাপা পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
সরকার দেশে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম পুনঃনির্ধারণের ঘোষণার সাথে সাথে দেশের পরিবহন সেক্টরে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। সরকারের ঘোষণার অর্থাৎ কিলোমিটার প্রতি কত টাকা ভাড়া বাড়বে তার প্রতি তোয়াক্কা না করে নিজেরাই ভাড়া নির্ধারণ করে ফেলেছে পরিবহন মালিকেরা। যার যেমন ইচ্ছা তেমন ভাড়া নেয়া শুরু করে। কিলোমিটারের হিসাব না করে পাঁচ টাকা ভাড়া দশ টাকা, উঠা নামা দশ টাকা হিসাবে ভাড়া নেয়া শুরু করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সিএনজি চালিত রাইড, রেঞ্জার, ভটভটি-ইত্যাদির চালকেরাও ভাড়া বৃদ্ধি করে ফেলেছে যদিও সরকার সি.এন.জি-র কোন মূল্য বৃদ্ধি করেনি। এদিকে ডিজেলের ট্যাংলরি, লং ভেহিকলগুলো ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার সাথে সাথে ধর্মঘটের ডাকদেয়। ফলে গত চারদিনে সারা দেশে মালামাল পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। একারণে দেশের স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে কন্টেনারের জট সৃষ্টি হয়। মালামাল পরিবহনে স্থবিরতা সৃষ্টি হবার কারণে দেশের অভ্যন্তরে জরুরি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। ব্যাহত হয় অভ্যন্তরীণ গার্মেন্ট শিল্পে উৎপাদন ও রফতানী।
এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেছেন জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি সময়োপযোগী হয়নি। পণ্য পরিবহন খরচ বৃদ্ধির দাবি অযৌক্তিক ও অবাস্তব বলে মত প্রকাশ করেছেন বি.জি.এম.ই-এর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আবার বিকে এম ই এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেস বলেছেন, পরিবহন ভাড়া বাড়ালে শিল্প কারখানা চালানো দুস্কর হবে। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, ব্যবসায়ীরা এমনিতেই ক্ষতির মধ্যে আছে। প্রতিযোগিতার বাজারে কম মূল্যে অর্ডার পাচ্ছে। আবার এদিকে দেশের প্রতিটি খাতে খরচ বেড়েছে। এখন পণ্য পরিবহন খরচ আরো বাড়ালে দেশের আমদানি-রফতানিতে খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু তাই নয় অভ্যন্তরীণ সব পণ্য পরিবহনে ভাড়া বাড়বে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে অর্থাৎ সব বোঝা ভোক্তা পর্যায়ে গিয়েই পড়বে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশও দেড় বছরেরও বেশী সময় ধরে কোভিড-এ রয়েছে, হয়ত আগামী কিছুদিনও থাকতে হতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। কোভিড এর কারণে দেশের স্কুল কলেজগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আংশিক খুলেছে। কোভিডের ভয়াবহতার সময়ে শিল্প কারখানা বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্প ছাড়া অন্যসব ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায়ই বন্ধ ছিল। শিল্প কারখানাগুলো তাদের লোকসান কমাতে অনেক ক্ষেত্রে তাদের কর্মচারীদের ছাটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে দেশে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমেছে। অনেকে চাকুরি ব্যবসা বাণিজ্য হারা হয়ে শহরে থাকার পরিবর্তে গ্রামে চলে গেছেন। এই পর্যায়ে দেশের জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের কাছে মরার উপর খাড়ার ঘা-এর মত হয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশেও তেলের দাম বাড়াতে হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম থাকার সময় দেশের অর্থনীতিবিদগণ এবং ক্যাব এর পক্ষ থেকে তেলের দাম কমানোর কথা বলা হলে সরকারের পক্ষ থেকে সেক্টরে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার যুক্তি দাঁড় করানো হয়।
বিপিসি গত সাত বছরে যে ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে বলে দাবী করেছে তা দিয়ে আরো বিশ বছর ভর্তুকি দিতে পারত বলে জানা গেছে।
ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে চার দিন ধরে মালামাল পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় বার হাজার রপ্তানি পণ্যের এবং দশ হাজার আমদানী পণ্যের জট লেগেছে। ধর্মঘট চলাকালে তিনটি হাজার কন্টেনার ছাড়াই বন্দর ত্যাগ করেছে। কন্টেনার পরিবহনের জন্য নতুন করে জাহাজ ভাড়া করে আনতে হচ্ছে বলে বাংলাদেশ শিপিং এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়। এদিকে এই কন্টেনার জট ছাড়াতে আরো পনের বিশ দিন সময় লাগবে বলেও চট্টগ্রাম চেম্বারের একজন পরিচালক জানান।
সরকার সম্প্রতি যানবাহনগুলোর কিলোমিটার প্রতি ২৭ শতাংশ এবং মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দিলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এর কোন প্রয়োগ হচ্ছে না। বাস-টেম্পো, রাইডার, রেইঞ্জারে এর চালকেরা ৩০ থেকে ষাট শতাংশ আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ডাবল ভাড়া নিচ্ছে। এ নিয়ে যাত্রীদের যুক্তির প্রতি তারা বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করছেনা। অন্যদিকে সিএনজি চালিত যানবাহনগুলোও ভাড়া বৃদ্ধি করে যাত্রীদের আনা-নেয়া করছে। এ প্রসঙ্গে যাত্রীদের তরফ থেকে প্রতিবাদ করা হলে তারা বলছে “সব জিনিসের দাম আমাদের ভাড়া কেন বাড়বে না”। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বিআরটিসির বাসগুলোও পঞ্চাশ থেকে একশ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত ভাড়া নিচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ নগরীতে ২৫ শতাংশ বাস ডিজেলে চললেও ৭৫ শতাংশ যানবাহন বাড়তিভাড়া নিচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটির তরফ থেকে বলা হয় গণশুনানী ব্যতিরেকে জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধি জনগণের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে সরকার। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অনেকগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেগুলো ডিজেলের মাধ্যমে চলে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধি এক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বাড়াবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পার্শ্ববর্তী দেশে ডিজেল-কেরোসিনের দাম বেশী হওয়ায়, পাচার কমাতে এখানেও দাম বৃদ্ধি করতে হয়েছে। ক্যাব অবশ্য বলেছে, সরকার যদি তেলের দাম না কমায় তারা আইনের আশ্রয় নেবে।
দেশে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে যাত্রী পরিবহন, মালামাল পরিবহন ইত্যাদির খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে শাক-শব্জী থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন নির্বাহের খরচ বেড়ে গেছে অনেকগুণ। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল ধারা গার্মেন্ট সেক্টরের মালিকেরা লোকসানে পড়বে। কারণ হঠাৎ করে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে যা তারা ক্রেতার সাথে সমন্বয়ের সময় পায়নি।
কোভিডকালীন সময়ে জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে তেলের দাম পুনঃনির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এছাড়াও তেল সেক্টরের দুর্নীতি দমনেও সরকারের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসভ্য সমাজ বিনির্মাণে আইন সংস্কার করা হোক
পরবর্তী নিবন্ধমহাপ্রাণ মহীয়সী নেলী সেনগুপ্তা : বিদেশিনীর ভালোবাসা