চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও পাবনার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এছাড়া খুলনা বিভাগের বাকি অংশ, রাজশাহী জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে দেশের বাকি অংশের উপর দিয়ে বইছে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় গতকাল দুপুর নাগাদ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক চার ডিগ্রি। এছাড়া রাজশাহীতে ৪১ দশমিক পাঁচ, খুলনায় ৪১ দশমিক দুই, পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪২, চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক চার এবং যশোরে ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বার্তায় বলা হয়েছে, দেশের উপর দিয়ে চলমান মৃদু থেকে তীব্র ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে এবং জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। খবর বিবিসি বাংলার। জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ, আবহাওয়াবিদ এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে আগামী কয়েক বছরে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার এমন বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। আর তার ফলে বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কা আছে তাদের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন প্রধান ভূমিকা রেখেছে। সেই সাথে ঢাকাসহ সারা দেশে তাপমাত্রার এমন বৈরী আচরণের জন্য অপরিকল্পিত নগরায়নেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
দেশি এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই বছরে অসহনীয় গরম দিনের সংখ্যা গত ছয় দশকে অন্তত তিন গুণ বেড়েছে। আর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স গরম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে বলছে, গত ২৮ বছরে ঢাকা থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার সমআয়তনের জলাধার ও ১০ বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ সবুজ কমে গেছে।
ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ আদিল খান মনে করেন, এটা শুধু ঢাকার চিত্র নয়। এখন জেলা উপজেলা পর্যায়েও পুকুর বা জলাধার ভরাট করে পরিকল্পনাহীন ভবন উঠে চলেছে। নগরগুলোর প্রতিটি ভবন পরিকল্পিত না হলে এবং এলাকাগুলোতে সবুজের ভারসাম্য আনা না হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।
তাপমাত্রায় নতুন রেকর্ড : বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে দাবদাহ বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও নতুন নতুন রেকর্ড হয়ে চলেছে। এর আগে ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল আগের ২৬ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হয়েছিল। ওইদিন দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে গতকাল ২০ এপ্রিল যশোরে ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রি। যদিও এক সাথে অনেকগুলো জায়গায় ৪০ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে এবার। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, একটি জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা তা থেকে পাঁচ ডিগ্রি বেড়ে গেলে এবং সেটি পরপর পাঁচদিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলা হয়। তবে অনেক দেশ এটিকে নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত করেছে। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেছেন, বাংলাদেশে দাবদাহ আগে এপ্রিল–মে মাসে অনুভূত হতো এবং জুনে বৃষ্টি শুরু হলে ধীরে ধীরে তা কমে যেত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে আগস্ট পর্যন্ত তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এমনকি শীতকাল বা শীতের দিনের সংখ্যা কমে গেছে গত ১০/১২ বছরে।
আবহাওয়া দপ্তরের হিসেবে বাংলাদেশে হিটওয়েভ বা দাবদাহ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। তবে এটা নির্ভর করে মানবদেহের খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপর। রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণায় ৪৪ বছরের তাপমাত্রার একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ বা কমিয়ে আনা সম্ভব? : আবহাওয়া ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধির প্রধান কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, যার জন্য উন্নত বিশ্বের বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বৈশ্বিক কারণ ছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং পরিবেশের অযৌক্তিক ক্ষতি করাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এখন ভবনগুলোর ডিজাইনই হচ্ছে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রেখে কিংবা শীতাতপ যন্ত্র যাতে বসানো যায় সে চিন্তা করে। অথচ আগে অনেক ভবন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে গরমকালে শুধু ফ্যানেই কাজ হতো।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে জলবায়ু নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে মেট্রো রেলের মতো বিদ্যুৎ চালিত গণপরিবহন বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণ করতে হবে। খাল, পুকুর–সব ভরাট হয়ে গেছে। জলাধার নেই। এগুলোই তো সাময়িকভাবে তাপমাত্রা কমাতে দরকার হয়। তবে নগরায়নের পাশাপাশি শহরগুলোকে কীভাবে আরো বেশি পরিবেশবান্ধব করা যায়, সে পরিকল্পনার ওপর জোর দেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মো. শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হওয়ার সাথে সাথে নগরায়ন বাড়বে। কিন্তু শহরগুলোকে একটি মাস্টার প্ল্যানের আওতায় এনে, গ্রিনারি বা সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। শহরগুলোর জনসংখ্যা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। শহরের সুবিধাগুলোকে শহরের বাইরে ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে জনসংখ্যায় ঘনত্ব কমাতে হবে। পাশাপাশি ভবনগুলোকে পরিবেশ বান্ধব করতে হবে।
কংক্রিটের পরিমাণ কমাতে হবে : ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ খান বলেন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কংক্রিটের পরিমাণ কমাতে হবে এবং বনায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে সেটা হলো ধ্বংসাত্মক নগরায়ন। ঢাকার এমন ওয়ার্ড আছে যেখানে ৯০ ভাগই কংক্রিট। গরম বেশি অনুভূত হয়, কারণ নগর এলাকায় গাছপালা, জলাধার ধ্বংস করা হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত ওপেন স্পেস রাখতে হবে। তার মতে নগরায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সবুজের পরিমাণ বাড়িয়ে নগরের ২৫–৩০ ভাগ সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ভবনগুলোর চারদিকে খালি জায়গা রাখতে হবে এবং এলাকাভিত্তিক পুকুর বা জলাধার রাখতে পারলে তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি রাজউক একটি নীতি প্রণয়ন করেছে, যেখানে প্লটের আকারভিত্তিক গাছের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ খান মনে করেন, এটি কার্যকর হলে কিছুটা কাজে আসবে। যত বেশি সবুজায়ন হবে ততই তাপমাত্রা সহনীয় হবে। জলাধার থাকতেই হবে। পাশাপাশি দুটি ভবনের মধ্যকার দূরত্ব এবং প্রতিটি ভবনের পরিবেশবান্ধব ডিজাইন করতে হবে। একই সঙ্গে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শীতাতপ যন্ত্র ব্যবহার হতে হবে নিয়ন্ত্রিত।