বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এদেশের অধিকাংশ অধিবাসী মুসলিম। তাই প্রধান ধর্ম ইসলাম। অন্যান্য ধর্মের সবাই নিজ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রেখে অন্যের ধর্মকে সম্মান দিয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মের দুইটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল-উল-ফিতর ও ঈদুল-উল-আযহা। আর বাংলাদেশি ও বাঙালিদের সর্বজনীন উৎসব হচ্ছে বৈশাখী উৎসব। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এক হয়ে যায়। এদেশে প্রতিটি মানুষ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো আনন্দ-বেদনায় পালন করে। আনন্দের সাথে বেদনা শব্দটি যোগ করার পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে থেকে সবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। মানুষের চাহিদার শেষ নেই। চাহিদা পূরণ করতে কেউ কেউ লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে চলছে। আর কেউ কেউ প্রতাড়িত ও বঞ্চিত হচ্ছে। উৎসব ও আনন্দের একটি কালো দিক হচ্ছে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, কালোবাজারী, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ভ্রাম্যমাণ আদালত, ভেজাল বিরোধী অভিযান, ইত্যাদি। বর্তমানে সরকার বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে এ সমস্ত মানব বিরোধী কর্মকাণ্ডকে নস্যাৎ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে যে হারে ভেজাল বিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে তাতে অনেক নামী-দামী প্রতিষ্ঠানের বাস্তব চিত্র জনসম্মুখে উন্মোচিত হচ্ছে। ঈদের আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো ঈদের সময় আরো অনেক বেশী চড়া দামে বিক্রয় হয়। তাতে সাধারণ আয়ের মানুষগুলো যেমন বঞ্চিত হয়। তেমনি অন্যরাও চড়া দামে ক্রয় করে প্রতাড়িত হয়। অনেক দামে ক্রয় করে অনেকে পরবর্তীতে নিজেদের মাসিক আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে হিমশিম খায়। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো কিনতে গেলে ভোক্তাদেরকে মূল্য ও মাপের দিকে ঠকানো হয়। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ঈদুল-ফিতর ও ঈদুল-আযহার আগে ও পরে এই ঘটনাগুলো বেশী ঘটে।
মানুষের জীবনে দুটো প্রবৃত্তি রয়েছে-একটি পশুবৃত্তি ও অন্যটি বুদ্ধিবৃত্তি। পশুবৃত্তিকে দমন করে বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ যখন জীবনকে সুন্দর, সুষ্ঠু ও সুপথে পরিচালিত করে তখনই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আদর্শ ও ন্যায় জীবন প্রতিষ্ঠায় মানুষকে লোভনীয় অনেক কিছু ত্যাগ ও বিসর্জন দিতে হয়। এই ত্যাগ, উৎসর্গ ও কোরবানি হচ্ছে পশুবৃত্তির বিসর্জন। কুরবানির মাধ্যমে নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার উম্মেষ ঘটবে। বিলুপ্ত হবে সব ধরনের হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, ক্রোধ। কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হয়। কুরবানির মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা হয়।
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পশুর ছবি প্রদর্শনে চলে এক ধরনের লোক দেখানো সংস্কৃতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোরবানির পশুর দাম জানানোর মাধ্যমে চলে মর্যাদার লড়াই। যে যত দামি পশু ক্রয় করতে পারে সে ততই অহংকার বোধ করে। বর্তমানে প্রায়ই দেখা যায়, হাটে যাওয়া থেকে শুরু করে, দর-দাম করে কেনা, নিয়ে আসা, ঘাস খাওয়ানো, জবাই করা, মাংস ছড়ানো, মাংস বিতরণ, ভাগ-বাটোয়ারা, রান্না-বান্না, শেষ পর্যন্ত খাওয়ার টেবিলের ছবিও পোষ্ট করা হয়। তাছাড়া কারা আগে রান্না মাংস খেয়ে তৃপ্তি মিটিয়েছে, তার ছবি পোস্ট করে নিজেদের তৎপরতার পরিচয় প্রকাশ করে। নিজের অবস্থান দেখানোর মাধ্যমে ঈদুল আযহার মাহাত্ম্য অনেকাংশে কমে যায়। এতে কোনো বীরত্ব ও বিশেষত্ব নেই। ইসলামে কোনো লৌকিকতার স্থান দেওয়া হয় না। এতে বরং ইবাদতের গুরুত্ব নষ্ট হয়। কোরবানির আনন্দ ঘরে বাইরে সকলের মধ্যে বিরাজ করে। তাইতো পশু ক্রয়ের অনেক আগে থেকে ঘরের গৃহকর্মীর ব্যস্ততা থাকে। মরিচ, মসলা কেনা তা শুকানো, ভাঙ্গানো, দা-বটিতে শান দেওয়া, চাউল ধুয়ে শুকানো, চাউল গুড়া করা, রুটি বানানোর জন্য মানুষ ঠিক করা, নতুন নতুন বড় ঢেকচি-পাতিল ক্রয় করা ইত্যাদি আনুষঙ্গিক জিনিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বর্তমানে কোরবানীর এই ঘরোয়া আনন্দ অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে। যান্ত্রিক যুগে সবাই প্রযুক্তির সেবা নিতে গিয়ে ঘরোয়া আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । মাংস ভাগ-বাটোয়ারা ও বিতরণের পর যে যার মাংস ফ্রীজে সংরক্ষণ করতে ব্যস্ত থাকে। প্রয়োজনমত ফাতেহার মাংস রান্নার পর তেমন আয়োজন থাকে না। তাই কোরবানির আনন্দটাও দুপুরের পর পর শেষ হয়ে যায়।
কোরবানির পশু ক্রয়ের সাথে দেশের অর্থনীতির চাকা সম্পৃক্ত থাকে। আমাদের দেশের চামড়া শিল্প মূলত কোরবানির পশুর চামড়ার উপর নির্ভর করে। পশুর হাটে নকল টাকা চিহ্নিত করার জন্য মেশিন বসানো হয়। পশুর হাটে আনা অবদি মাঠে-ঘাটে চাঁদাবাজি চলে। সকল ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করলেও প্রতি বছর একই চিত্র ঘটতে থাকে। তাছাড়া ক্ষতিকর ঔষুধ খাওয়ানোর ফলে অনেক পশুর মৃত্যুর খবর শুনা যায়। মোটা তাজা করার জন্য পশুকে ঔষধ খাওয়ানোর ফলে পশুগুলো আকারে বড় হলেও প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যসম্মত থাকে না। অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় নিরূহ পশুগুলোর উপর অত্যাচার করা হয়। পশুর চামড়ার সঠিক সংরক্ষণ ও বিক্রয় দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ নিয়েও চলে নানা প্রকার প্রচার-প্রচারণা। বিশেষ করে ঈদের দিনে যেখানে সেখানে কোরবানির পশু জবাই না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। যেখানে-সেখানে কোরবানির পশু জবাই করলে যেমন পরিবেশ নষ্ট হয়, তেমনি যেখানে-সেখানে কোরবানির পশুর হাট বসলেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই কোরবানির ঈদের অনেক আগে থেকেই পশুর হাট, জবেহ স্থান, বর্জ্য অপসারণ, চামড়া ছড়ানোর জন্য প্রচার-প্রচারণা চলে। ইফতার মাহফিল, ঈদুল ফিতর, যাকাত প্রদানের মত ঈদুল আযহার সময় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ করার জন্য ঈদুল ফিতরের মত ঈদুল আযহায়ও সমর্থকদের নিয়ে মেজবানের ব্যবস্থা করা হয়। তাই পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকে ঈদুল আযহার গুরুত্ব অসীম। বর্তমান বাংলাদেশে যে হারে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ও প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা-অঘটনা মানুষের মাঝে উপনিহিত পশুবৃত্তির বহি:প্রকাশ। তাই কোরবানির আদর্শগত শিক্ষা গ্রহণ করে পশুত্বকে বিসর্জন দিয়ে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শুধুমাত্র ‘আমি ও আমার মঙ্গল নয়, বরং আমাদের সকলের মঙ্গল’ এমন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ঈদুল আযহার কোরবানির আসল উদ্দেশ্য ।
ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে নতুন সাজে নিজেকে সাজানো। আমাদের দেশের একটা বিরাট অংশ নিম্ন-আয়ের মানুষ। এই বিরাট অংশের আরো একটি অংশ বিভিন্ন পোশাক-শিল্পে চাকুরীরত। সারা বছর বিভিন্ন পোশাক শিল্পে কর্মরত এই মানুষগুলো খেটে চলে। তেমন ছুটি-ছাটা পায় না। ঈদের এক দুইদিন আগে ছুটি পায়। তখন তারা দলবেঁধে বাড়ীর উদ্দেশ্যে ছুটে চলে, তখনি বড় বড় রাস্তাতে বেশী চাপ পরে। এখানে উল্লেখ্য, যারা সারাবছর পরিশ্রম করে পোশাক শিল্পগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা তাদের ন্যায্য বেতন ও বোনাসের জন্যে ঈদের আগে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হয়। পোশাক-শিল্পের মালিকরা সহজে তাদের বেতন ও বোনাস পরিশোধ না করাতে তাদেরকে ন্যায্য পাওনার জন্য রাস্তায় নামতে হয়। অনেক সময় পুলিশের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় উওেজিত শ্রমিকরা বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ভাঙচুর করে। এতে সম্পত্তির ক্ষতি হয়। ফলাফলে মালিক পক্ষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শ্রমিকরা তাদের পাওনা ঠিকমত পায় না। এই ধরনের পরিস্থিতি প্রতিটি ঈদের আগে ঘটতে দেখা যায়। অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও বেতন, বোনাস নিয়ে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে বিবাদ সংঘটিত হয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের ঈদের আনন্দপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হয়।
ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে সকলের মুখে হাসি। আমাদের দেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন-বসতবাসীর মানুষগুলো ঈদের সময় নিজেদের মত করে আনন্দ করে। সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে যে যার পরিবারের জন্য ন্যূনতম জিনিস ক্রয় করে। বিভিন্ন সংগঠন ঈদুল-ফিতরের ও ঈদুল আযহার সময় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। নিজেদের তত্ত্বাবধানে খাবার তৈরী করে এই দুস্থমানুষদের মাঝে বিলিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে। এই দিনগুলোতে আমাদের দেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পথশিশু ও ছিন্নমুল শিশুরা ফ্রিতে শিশুপার্কে বেড়াতে পারে। হোক না কয়েকটা দিন। তবুও এই কয়েকটা দিন আমাদের এই রিক্ত-সিক্ত শিশুরা পরম আনন্দে শিশু পার্কগুলোতে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল আবার এই শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। তাছাড়া বিভিন্ন পেশার নিম্ন-আয়ের মানুষের অংশগ্রহণে পরিচালিত টিভি অনুষ্ঠানগুলো আমাদের ঈদ আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়। সংযম, সহনশীলতা, সহানুভূতির শিক্ষা নিয়ে আমাদের এদেশের সকল স্তরের মানুষগুলো যেন ঈদের দিনগুলোতে আনন্দ উপভোগ করতে পারে তার জন্য আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। অন্তত এই কয়েকটি দিন সকলে সকলের তরে এক হবে। তৈরী হবে এক নতুন ভূবন, থাকবে না দু:খ, কষ্ট-বেদনা, থাকবে শুধু ঈদ আনন্দ। বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এই দেশের প্রতিটি মানুষ নিজের ধর্ম ও কৃষ্টি স্বাধীণভাবে পালন করে। এখানে বাধা ধরা নিয়ম নেয়। “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার এই ধারণাকে মেনেই সবাই নিজস্ব আঙ্গিকে আচার-আচড়ণ পালন করে। যখন ঈদ আনন্দ শুরু হয় তখনো আমাদের সাথে আমাদের অন্য ধর্মাবলম্বী পরিচিতজনরা আমাদেরকে শুভেচ্ছা জানতে আসে। আমাদের এই ঈদ আনন্দে আমাদের নিকট আত্মীয়-স্বজনও বন্ধু-বান্ধবীর পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পরিচিতজনের শুভেচ্ছা বিনিময় আমাদের মহৎ হৃদয়ের পরিচয় বহন করে। তাছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে আমাদের মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের অধিবাসীদের কেউ কেউ উপস্থিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে রাস্ট্রীয় অতিথি ভবনে আমাদের রাষ্টপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রীদের উপস্থিতি সকল ধর্মের মানুষের সমাগম আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় বহন করে। আমাদের প্রধান দুইটি ঈদের সময় রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় সকলের উপস্থিতি আমাদের ঈদ আনন্দকে আরো বাড়িয়ে তোলে, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রিতি দৃঢ় হয়।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।