বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপের পরও সংক্রমণ, মৃত্যুহার উর্ধ্বমুখী থাকায় সংকট আরো বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জেলা ভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে করোনার যে নতুন ধরন দ্বিতীয় ঢেউয়ের সূচনা করেছিল বাংলাদেশেও একই ভ্যারিয়েন্টগুলোর উপস্থিতি থাকায় উদ্বেগ বেড়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারা দেশে এক সপ্তাহের বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও সেটি উপকারে আসবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সেটি কার্যকর করতে প্রয়োজনে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি বা কারফিউ জারি করা দরকার। খবর বিবিসি বাংলার।
কেন উদ্বেগ : আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবির তথ্যে বলা হয়েছে, নতুন আক্রান্তদের ৮১ শতাংশই হলো দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। এছাড়া যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের নতুন ধরনটির উপস্থিতি আগেই নিশ্চিত হওয়া গেছে বাংলাদেশে।
সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে আইসিডিডিআরবির এমিরেটাস বিজ্ঞানী এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন বিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ড. ফেরদৌসী কাদরী বলেন, আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি, ভ্যারিয়েন্টগুলো কী তাড়াতাড়ি স্প্রেড করেছে। যুক্তরাজ্য থেকে আরম্ভ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। এগুলোর ইনফেকশন রেট হায়ার, ট্রান্সমিশন অনেক হাই। তবে সিভিয়ারিটির বিষয়টা আরো গবেষণা করে বলতে হবে।
মহামারি শুরুর পর দেশে গত এক মাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া গত এক সপ্তাহে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে সাত হাজারও অতিক্রম করেছে। মৃত্যুও বেড়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভাইরাসের গতিবিধি এবং দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলছেন ২য় ওয়েভ আরো বেশি শঙ্কা ও দুশ্চিন্তার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ বলেন, আমাদের এখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কিছু ধরন আছে। ইউকে ভ্যারিয়েন্ট নিশ্চিত আছে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টও আছে। বাংলাদেশেও যে ধরনটা আগে ছিল সেটাও মনে হচ্ছে তাতে মিউটেশন হয়ে আগের চেয়ে বেশি মারাত্মক সংক্রমণ করা, মৃত্যু বেশি হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
সরকারি হিসেবে এপ্রিল মাসে প্রায় প্রতিদিন অর্ধশতাধিক মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মহামারি শুরুর পর ৮ এপ্রিল একদিনে সর্বোচ্চ ৭৪ জনের মৃত্যু হয়। এখন প্রায় সব হাসপাতালের আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর রোগীতে ভরে গেছে। অক্সিজেন সুবিধাসহ বেড খালি না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের নিয়ে স্বজনদের ভোগান্তি হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন চিকিৎসকরা।
বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের কোষাধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শর্মিলা হুদা বলেন, আগে যে রকম হাসপাতালে ভর্তি হবার পর অন্তত দশ দিন আমাদের হাতে সময় থাকত। যখন কেউ একজন আক্রান্ত হতো আমরা কিছুটা সময় পেতাম। এখন যে ওয়েভটা চলছে আমরা সেই সময়টা পাচ্ছি না।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় : সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে এক সপ্তাহের জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক লকডাউন ন্যূনতম ১৪ দিন হতে হয়। আবার যেভাবে বিধিনিষেধ পালিত হচ্ছে তাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব হবে সে প্রশ্ন উঠেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বোচ্চ কঠোর হবার তাগিদ দিচ্ছেন।
বে-নজির আহমেদ বলেন, আমার মত হলো, একটা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা দরকার। স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা। এ জরুরি অবস্থার আওতায় ক্ষিপ্রতার সাথে সব দিক থেকে যদি ম্যানেজ করা যায় তাহলে একটা সমাধান হতে পারে।
এদিকে মানুষের মধ্যে বিধিনিষেধ মানার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা গেছে। জোরালো দাবির মুখে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার সুযোগ এবং গণপরিবহন চালু করা হয়েছে। বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য অভিযান পরিচালনার কারণে সরকারি অফিসে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে শর্মিলা হুদা বলেন, কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কেউ বাইরে না যায়। আমার মনে হয়, কারফিউ ছাড়া মানুষজনকে ঘরে রাখা সম্ভব না
দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে ভ্যাকসিন : করোনা মহামারি ঠেকাতে বড় জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। দেশে এরই মধ্যে টিকার ২য় ডোজের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক টিকা কর্মসূচি শুরুর পর এ পর্যন্ত ৫৫ লাখের বেশি মানুষ প্রথম ডোজের টিকা গ্রহণ করেছে। মহামারি মোকাবেলায় টিকাদান কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেন বিশেষজ্ঞরা। তবে টিকা নিয়েও রয়েছে চ্যালেঞ্জ।
ড. ফেরদৌসী কাদরী বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের আগে বাংলাদেশ টিকা কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে এ ব্যাপারে আরো তৎপরতা প্রয়োজন। ভ্যাকসিনের অভাবটা কিন্তু পৃথিবী জুড়ে। এটা শুধু বাংলাদেশে না। তারপরও আমরা কিনে এনেছি, গিফট পেয়েছি এবং কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতে পাব। তিনটা মাধ্যমে পাচ্ছি। কিন্তু এরপরও বসে থাকার সুযোগ নেই। আমাদেরকে টিকার জন্য আরো চেষ্টা করতেই হবে।
মহামারি মোকাবেলায় টিকার উৎপাদনের সক্ষমতা কাজে লাগানো দরকার বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বেশ কিছু ওষুধ কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা আছে, যা কাজে লাগানোর মোক্ষম সময় এটি।
বে-নজির আহমেদ বলেন, আমাদের উচিত ছিল প্রথম থেকেই তিন-চারটা ভ্যাকসিন নিয়ে এগোনো, যাতে করে হাতে অপশনগুলো বেশি থাকত। একটা ভ্যাকসিন না হলে আরেকটা ভ্যাকসিনের জন্য আমরা চেষ্টা করতে পারতাম।












