কিশোর গ্যাং স্টার : রুখবে কে

সৈয়দ দিদার আশরাফী | রবিবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

গণমাধ্যম ও সামাজিক জীবনে খুব জনপ্রিয় শব্দ কিশোর গ্যাং স্টার। প্রশ্ন হচ্ছে এদের রুখবে কে? একদা পাড়ায় মহল্লায় কিংবা ইউনিয়নের সন্ত্রাসীদের প্রভাব ছিল বেশি। ইদানীং এ ধারা পরিবর্তন হয়ে নতুন ডিজিটাল ধারায় এসে ফোকাস হচ্ছে কিশোর গ্যাং স্টার। প্রসঙ্গত কিশোরদের সংঘবদ্ধভাবে অপরাধ করার প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম তথা দেশে প্রতিটি জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বহু ‘কিশোর গ্যাং স্টার’ গড়ে উঠেছে এবং তাদের ‘গ্যাং কালচার’ জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মানুষের মধ্যে ভীতি, আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কোনো অবধি নেই। রাজধানী ঢাকাতেই যেখানে শাসন-প্রশাসনসহ প্রায় সবকিছুর কেন্দ্র, সেখানে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা কত হতে পারে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, কিশোর গ্যাং স্টার সংখ্যা রাজধানীতে ৬২ সদস্য বিশিষ্ট বলে জানা গেছে। আরো উল্লেখ্য যে, রাজধানীতে কিশোর গ্যাং স্টার প্রতিদিন সক্রিয় রয়েছে ৪২টি এটি গণমাধ্যমে পরিসংখ্যান। প্রসঙ্গত, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সিলেট এবং অন্যান্য বড় শহরে এরকম বহু কিশোর গ্যাং স্টার রয়েছে। গ্রামে-গঞ্জেও গ্যাং কালচারের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। প্রতিটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন। এদের বয়স ১৪-১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে। এরা সর্বত্র দোর্দণ্ডপ্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন কোনো অপরাধ-অপকর্ম নেই যার সঙ্গে এই গ্রুপগুলো জড়িত নয়। মাদকাসক্তি, মাদককারবার, সন্ত্রাস, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি সবকিছুতেই তারা হাত পাকিয়েছে। তাদের হুমকি-ধমকি প্রদান, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অত্যাচার-জুলুমে মানুষ সদা সন্ত্রস্ত ও অসহায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পর্যন্ত এদের তৎপরতায় বিচলিত। এদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় থাকলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না। সামপ্রতিককালে রাজধানী ঢাকার ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম কিশোর গ্যাং সদস্যদের চিহ্নিত করার ও তাদের গতিবিধির ওপর নজর দেয়ার জন্য পুলিশের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। গ্যাং কালচার বিস্তারের পেছনে প্রাপ্ত বয়স্ক পেশাদার সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের বড় রকমের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এরা কিশোর গ্যাংগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা ও ছত্রছায়া দিয়ে থাকে। বিনিময়ে কিশোর গ্যাংগুলো তাদের হয়ে কাজ করে। অন্যদিকে, কিশোর গ্যাংগুলো রাজনৈতিক বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের একাংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তাদের হয়েও গ্যাংগুলো কাজ করে। এই দ্বিবিধ ‘সহায়ক শক্তির’ জোর পেছনে থাকার কারণে কিশোর গ্যাং দমন একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
কিশোররা স্বভাবতই অ্যাডভ্যাঞ্চারপ্রিয়। সবকিছু বেতোয়াক্কা করার একটা প্রবণতা তাদের মধ্যে আছে। এছাড়া যা নিষিদ্ধ এবং যাতে বারণ, তার প্রতি একটা দুর্বার আকর্ষণও তাদের মধ্যে রয়েছে। তাদের এই স্বভাব ও প্রবণতার কারণেই তারা অনেক সময়ই বিভ্রান্ত হয়, বিপথগামী হয়। আর একবার বিপথে গেলে ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। একারণে শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠা ও গড়ে ওঠার সময় বাবা-মা ও অভিভাবকদের যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়। কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা গ্যাং কালচারের বিস্তার দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আজকে যারা শিশু ও কিশোর, আগামী দিনে তারাই দেশ চালাবে। স্বাভাবিক নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধবর্জিত ঘাতক-নাশক, সন্ত্রাসী ও মাদকখোররা যদি তখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তবে দেশ ও মানুষের অবস্থা কী হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। দেশ-জাতির কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য নৈতিক বলে বলীয়ান, জাতীয় ও ধর্মীয় আদর্শে উজ্জীবিত, সুস্থ-সবল ও সুনাগরিক প্রয়োজন। সেটা গড়ে তুলতে হবে প্রজন্মের শিশু-কিশোরকাল থেকেই। আমাদের শিশু ও কিশোরদের একাংশ ধ্বংসের পথে, সর্বনাশের পথে ধাবমান। তাদের ফেরাতে হবে যে কোনো মূল্যে। এ ব্যাপারে সময়ক্ষেপণের অবকাশ নেই। কীভাবে তারা বিপথ-কুপথ থেকে ফিরবে? সেটা আমাদের এখনই ভাবতে হবে। নিতে হবে ত্বরিত পদক্ষেপ। বলা বাহুল্য, আমাদের যে কিশোররা ঘাতক, নাশক, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী ইত্যাদি হয়ে যাচ্ছে, তাদের আগে মানুষ বানাতে হবে। এ লক্ষ্যে তাদের জন্য পরিবারকে সময় দিতে হবে। বাবা-মাকে সঙ্গ দিতে হবে, সহমর্মী ও সহৃদয় হতে হবে। পরিবারেই নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের শিশু বা কিশোর সদস্য কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, লেখাপড়া ঠিকমত করছে কিনা, জ্যেষ্ঠ সদস্যদের তা খেয়াল রাখতে হবে। শিক্ষাবিদ ও সরকারের দায়িত্ব হলো, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত হয় এমন বিষয় পাঠসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা। অবশ্যই পেশাদার সন্ত্রাসী এবং দুর্বৃত্তাচারী রাজনীতিকদের কবল থেকে তাদের মুক্ত করতে হবে। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিশোর গ্যাং স্টার দমনে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজেরও দায়িত্ব আছে। কিশোর গ্যাং স্টারদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে পাশাপাশি অভিভাবকদের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারলে কিশোর গ্যাং স্টার প্রবণতা কমে আসতে বদ্ধপরিকর।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্পর্কের নানান জটিলতা
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে