কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি : সমাজের এক ব্যাধির নাম

লালন কান্তি দাশ | শনিবার , ১১ জুন, ২০২২ at ৬:৫৬ পূর্বাহ্ণ

চালচলন দেখেই এদের অনেকটা চেনা যায়! মুখে সদ্য গজানো দাড়িগোঁফ কিংবা উঠি উঠি করছে এমন চিহ্নরেখা। অদ্ভুত হেয়ার কাট, কাউকে বা কোনো কিছুকে এরা পরোয়া করে না। দলবেঁধে থাকে, ভাবভঙ্গি সবসময় আক্রমণাত্নক। নেশা করে। এদেরকে শাসন বা কোনো কিছু বলা যায় না। বাঁধা দিলে হাতাহাতি, রক্তারক্তি ঘটায়। নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এরা যুক্ত থাকে। এরা মূলত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।

বর্তমান সময়ে আলোচিত এবং একইসাথে আতংকের নাম কিশোর গ্যাং। বাংলাদেশের শিশু আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সের কেউ অপরাধে লিপ্ত হলে তাকে কিশোর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি হল কিশোর অপরাধের একটি দিক। প্রচলিত ধারণায় গ্যাং হল একইরকম চিন্তা ও মানসিকতা লালনকারী একদল মানুষ, যারা সংগঠিত হয়ে নৈতিক, সামাজিক এবং আইনগতভাবে স্বীকৃত নয় এমন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। সে বিবেচনায় একাধিক কিশোর যখন সংগঠিত হয়ে অপরাধে জড়ায়, তখন তাকে বলা হচ্ছে কিশোর গ্যাং কালচার বা সংস্কৃতি।

কিশোরকাল মানুষের জীবনে সবচেয়ে মধুর ও গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচিত। পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২১ ভাগ কিশোরকিশোরী। সে হিসেবে এ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তিন কোটিরও বেশি। শুধু সংখ্যাগত বিচারে নয়, সামগ্রিক মাপকাঠিতে এ জনগোষ্ঠীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে তাদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠা খুবই জরুরি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি দেশ ও জাতির অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি! শুরুতে এটি নগর কেন্দ্রিক থাকলেও এখন সারাদেশে তা বিস্তার লাভ করেছে। যে বয়সে কিশোরদের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, খেলার মাঠে বিচরণ কিংবা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার কথা তার পরিবর্তে শিশুকিশোরদের একটি অংশ যখন ছুরি, রামদা, কিরিচ কিংবা মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন তা সমাজের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ বৈকি! আড্ডাবাজি, বখাটেপনা, ইভটিজিং, হাতাহাতি দিয়ে এদের অপরাধের যাত্রা শুরু হলেও ধীরে ধীরে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, খুনের মত নৃশংস অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আগে গ্যাং কালচারে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের আধিক্য দেখা যেত। বর্তমানে সব শ্রেণির পরিবারের সন্তানরা এতে যুক্ত হচ্ছে।

কেন অপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশের এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির আবির্ভাব? প্রকৃতপক্ষে বহু কারণে সমাজে এই সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে। প্রধানত বাহাদুরি দেখানো এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভট সব নাম দিয়ে কিশোর গ্যাংগুলো গড়ে উঠে। তাছাড়া সঙ্গদোষ, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক নীতিহীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা, বয়সের অপরিপক্কতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার, অপসংস্কৃতির জোয়ার ইত্যাদি এর উল্লেখযোগ্য কারণ। সমাজ গবেষকদের মতে, কিশোর অপরাধের অন্যতম কারণ সুস্থ বিনোদন বা সংস্কৃতি চর্চার অভাব। পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, লাইব্রেরী নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই, সৃজনশীলতা বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র নেই। ফলে শিশুকিশোরদের মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। আগে আমাদের সমাজে ছোটরা বড়দের মান্য করত, সালাম দিত। বিপরীতে বড়রা ছোটদের ভুল ধরিয়ে দিত, শাসন করত। এখন এইচর্চা দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। অনেক পরিবারে বাবামা রোজগারে ব্যস্ত। সন্তানরা কোথায় যায়, কাদের সাথে মেলামেশা কিছুই খোঁজ রাখে না। ফলে অভিভাবকদের অজান্তেই অন্ধকার পথে পা বাড়ায় তাদের সন্তানরা। কিশোর অপরাধের প্রভাবশালী কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক নীতিহীনতা। বর্তমানে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। চাঁদাবাজি, অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে প্রতিটি এলাকায় প্রতিপক্ষ হিসেবে একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হচ্ছে এবং তারা প্রতিনিয়ত প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এতে সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। প্রতিটি কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে একজন বড় ভাই থাকেন। এসব কথিত বড় ভাইদের আশ্রয়প্রশ্রয়ে তারা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠে। তাছাড়া কিশোররা যখন দেখে অপরাধ করে অপরাধীরা ধনী হচ্ছে, ক্ষমতাবান হচ্ছে তখন তারাও এভাবে বড় হতে চায়। অর্থাৎ পেশীশক্তি, দুর্নীতি, অনিয়ম এক কথায় সমাজে অপরাধের উপাদান বিরাজমান থাকলে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কাজ করবেই। অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়ে তিরস্কারের শিকার বা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে অনেক সময় ভুল পথে পা বাড়ায়। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে বিভিন্ন কারণে জন্ম নেয়া কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে উইপোকার মত খুবলে খাচ্ছে, লাগাম টানা না গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দ্রুত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই সর্বনাশা সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত বা নিয়ন্ত্রণে আনা খুবই জরুরি। এ লক্ষ্যে পরিবার সবচেয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শিশুকাল থেকেই সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পিতামাতাকে অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে। সন্তানকে চারিত্রিক শিক্ষা ও সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে, সময় দিতে হবে, তাদের বন্ধুদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর অধিক জোর দেয়া প্রয়োজন। প্রত্যেক পাড়ামহল্লায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি গঠন করে সংশ্লিষ্ট এলাকাকে অপরাধমুক্ত রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। কিশোরদের রাজনৈতিক সংস্পর্শ বা বলয় থেকে মুক্ত রাখা গেলে তা কিশোর অপরাধ দমনে অধিক ফলপ্রসু বিবেচিত হতে পারে। প্রতিটি গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আটককৃত কিশোরদের সঠিক পরিচর্চা ও প্রশিক্ষণ জরুরি। কিশোর গ্যাং এর তৎপরতা যেসব এলাকায় বেশি সেখানে পুলিশের টহল বাড়াতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন এলাকায় খেলার মাঠ নির্মাণ ও খোলা জায়গা সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাড়ামহল্লায় লাইব্রেরি স্থাপন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত ও বিকশিত করার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। শিশুকিশোরদের বিপথগামী করে তুলতে পারে এ জাতীয় অ্যাপস, অনলাইন গেমস নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে কিশোর অপরাধ দমন সম্ভব নয়। প্রশাসনের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা ও উদ্যোগের মধ্য দিয়ে কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং সংস্কৃতিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ বা কমিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক: প্রভাষক, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রাচীর
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে