রাজনীতির আদর্শ বা উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের সেবা বা কল্যাণ। রাজনীতিতে ভালো মানুষরা আসবে, দেশ ও দশের কল্যাণে তারা নিবেদিত হয়ে কাজ করবে, সাধারণ জনগণ সেটাই প্রত্যাশা করে। রাজনীতিতে দরকার শিক্ষিত সজ্জন ব্যক্তি। সুস্থ, সুন্দর পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রতি আমাদের সমর্থন ও শ্রদ্ধা অবশ্যই থাকতে হবে। আমাদের ছাত্র রাজনীতিরও রয়েছে গৌরবজনক ইতিহাস। সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তৎকালীন অনেক ছাত্রনেতাদের জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠার অনেক উদাহরণ দেখেছি। কিন্তু সেই রাজনীতির উদাহরণ যেনো ক্রমশ সংকোচিত হয়ে পড়ছে। প্রকৃত সজ্জন শিক্ষিত ব্যক্তিরা সমাজের হালচাল দেখে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ থাকলেও দুর্বৃত্তায়নের সাথে না পেরে রাজনীতির দৃশ্যপটের বাইরে থাকতেই পছন্দ করেন। ফলে রাজনীতির প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাঠ একশ্রেণির দুর্বৃত্তদের দখলে চলে যাচ্ছে। সমাজে রাজনীতির শক্তিকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সেই শক্তির বলয়ে যোগ হচ্ছে এক শ্রেণির কিশোর। যারা রাজনীতিকে বুঝার আগে রাজনীতির শক্তিকে নানা অপরাধে ব্যবহার করার সুযোগ হিসাবে নেয়। এটি সময়ে সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দৃশ্যপটও বদলায়। প্রত্যেক সরকারের সময়ে এ শ্রেণির লোকেরা ঐ সময়ের রাজনীতির নামে অপরাধ করার সাহস দেখায়। কিছু রাজনীতিকের থাকে প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন ইন্ধন। প্রত্যেক জায়গায় একটা ‘চেইন অব কমান্ড’ আছে। এটা প্রশাসনসহ সর্বস্তরে বিদ্যমান। রাজনীতিতে এই ‘চেইন অব কমান্ড’ একেবারে ওপরের লেবেল থেকে গ্রামীণ প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। কিছু কিছু ব্যক্তি তার রাজনীতির বলয়কে বিস্তৃত করার জন্য সমাজের নানা শ্রেণির কিশোরকে নিজের দলে রাখতে সচেষ্ট থাকেন। তারা বুঝে না রাজনীতি, বুঝে না সমাজ ব্যবস্থার নানা গতি-প্রকৃতি। তারা রাজনীতির ছায়াতলে নিজেকে মেলে ধরার প্রয়াসী হয়। নিজের ক্ষমতাকে জাহির করার জন্য অনেক নেতাই এ কাজটি করেন সচেতনভবেই। এই কিশোররা ছোটখাট অপরাধ থেকে রড় অপরাধে পা বাড়ায়। তাদের ব্যবহার করে ফায়দা নেবার কারণে অনেক রাজনৈতিক নেতারা এক সময় তাদের ঘৃণিত কার্যকলাপে বাধা প্রদান করতে নিজেরাই অসহায় হয়ে পড়েন। অবশ্য সব রাজনীতিকদের ঢালাওভাবে এক্ষেত্রে দায়ী করার সুযোগ নেই। এসব কিশোররা ঐসব নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাজনীতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছায়াতলে এক ধরনের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। তারা যখন দেখে পুলিশ তাদের কথা শুনছে, তাদেরকে সমীহ করছে,সমাজে তারা যেটা বলছে সেটাই গুরুত্ব পাচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে কারো কারো প্রচ্ছন্ন শক্তি, তখন সে ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সামপ্রতিককালে ঘটে যাওয়া নানা অপরাধের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, এই সমস্ত অপরাধীর পিছনে কোথাও কোথাও কোনো কোনো নেতার বা রাজনীতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব আছে এবং ঐ অপরাধী কিশোররা আকার ইঙ্গিতে বা আচরণে কোন রাজনৈতিক দলের পরিচয় দেবার চেষ্টা করে এবং তাদেরকে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিবৃত্ত করে না। এদেশে এমন একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যে, রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা থাকলে ক্ষমতা- আর ক্ষমতা থাকলেই কিছু মানুষ মনে করে অপরাধ করেও পার পাওয়া যায়। কারণ সেই অপরাধীর সামনে রাজনীতি করার কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছে এমন উদাহরণ হয়তো অনেক আছে। অপরাধের যে সংবাদগুলো আমরা মিডিয়াতে দেখছি, এগুলো অনেক ভেতরে ভেতরে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার দু’একটি চিত্র। অন্তরালে রাজনীতির ছত্রছায়া আরো অনেক ঘটনা ঘটছে, যা হয়তো মিডিয়াতে আসছে না, কিন্তু সমাজের বিষফোঁড়া হয়ে সেগুলো আমাদের সমাজে অপরাধ প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। কোনো জায়গায় কোনো অপরাধ সত্যিকার ঘটলে প্রথমেই সেখানে যদি কারো রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজে পাওয়া, তাহলে পুলিশ এক পা এগিয়ে গিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসে। অনেক চিন্তা ভাবনার মেরুকরণে ঘটনা নানা দিকে মোড় নেয়। আর আমাদের দেশে এ রকম কোন ঘটনা ঘটলেই প্রথমেই সোজা সাপটা বলে দেয়া হয়, ‘তারা দলের কেউ না’, ‘অপরাধী যেই হোক তাকে শাস্তি পেতেই হবে’, ‘আর এ রকম ঘটনা যেনো না ঘটে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অপরাধের সাথে সবচাইতে বেশি উচ্চারিত এ শব্দগুলো। কিন্তু অপরাধ কমে না বরং দিন দিন ধর্ষণ, খুন বেড়েই চলে।
রাজনীতিতে অর্থবিত্তই সব নয়, রাজনীতি মানে অনেক চিন্তাভাবনা, দূরদর্শীতা, সমাজ সচেতনতা, সামাজিক কল্যাণসহ অনেক ভাবনার প্রসারতা। কিন্তু অনেকের কাছে রাজনীতি এখন অর্থবিত্ত এবং ক্ষমতা। মানে এদেশে অর্থ-বিত্ত হলেই রাজনীতি করা যায়। সেখানে আর কিছু ভাবা লাগে না। কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার রাজনীতির দুর্বৃত্তয়ানই অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যতক্ষণ না অপরাধের শিকড় ধরে টান দিতে না পারেন, ততক্ষণ অপরাধের সে বৃক্ষে এ ডাল কাটলে,ও ডাল গজাবে। কারণ শিকড়তো রয়েই গেছে। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে ‘আইওয়াশ’ বলে একটা কথা আছে। যার অর্থ জনগণকে দেখানো, চোখের সামনে অপরাধীদের শাস্তির জন্য অনেক কিছুই করা হচ্ছে। আমরা অনেক সময় এই ‘আইওয়াশ’ই দেখে থাকি। দিন শেষে সব ভুলে যাই। কিছু কিছু শাস্তি প্রদানের উদাহরণও আছে, তাও অনেক সময় নিয়ে হচ্ছে,কিন্তু সংঘটিত অপরাধের তুলনায় তার হার নিতান্তই কম। কার কতটুকু মনে আছে ‘আপন জুয়েলার্সে’র মালিকের ছেলের ধর্ষণ, আলোচিত তনু ধর্ষণ ও হত্যা,গাজীপুরে ধর্ষণের বিচার না পেয়ে বাবা মেয়ের ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা, তুফান আলী নামক একজন স্থানীয় নেতা ধর্ষণের পর মা মেয়েকে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার মত আলোচিত ঘটনাগুলো? এর বাইরেও আছে নানা ঘটনা। রাজনীতির আশ্রয়- প্রশ্রয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের সৃষ্টি হয়। তারা রাজনীতিকে অপরাধ করার শক্তি মনে করে। নিজেকে এক ধরনের ক্ষমতাবান মনে না করলে অপরাধ করার সাহস জন্মে না। অপরাধ করার অনেক উপাদান বা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু রাজনীতি যখন কারো কারো অপরাধ করার হাতিয়ার হয়, তখন এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না। এরকম দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যাবার পর, তার অস্বীকৃতি বা দায় এড়ানো গেলেই কি সেই ক্ষতি মোচন হয়ে যায়? ভিকটিমের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায় তার ক্ষত তাকে সারাজীবনই বয়ে বেড়াতে হয়। আমরা কয়জনই বা তা মনে রাখি? ইংরেজ লেখক গ্যাব্রিয়েল হার্ভে বলেছেন,‘একটি অপরাধ একবার ক্ষমা করলে দুইবার করার আগ্রহ জন্মে।’ তদন্ত হচ্ছে একটা সিঁড়ির মত। ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয়। সে ধাপের কোথাও কোথাও গিয়ে থেমেও যেতে হয়। কারণ শিকড় ধরে টানবে কে? দেশে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যে লোকগুলোকে আমরা দেখি, তাদের অধিকাংশই এখন ব্যবসায়ী শ্রেণির। সমাজ চিন্তনের ভাবনাগুলো সমাজের যে সমস্ত মানুষগুলোর মধ্য থেকে আসে, সে সমস্ত মানুষগুলোর ওখানে আরো অনেক প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকা দরকার। বিচারহীনতার পাশাপাশি বিচারের দীর্ঘসূত্রতা অপরাধের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। জঘন্য একটা অপরাধ ঘটতে না ঘটতে আরেকটি অপরাধ ঘটে যাচ্ছে। একটির বিচার হতে হতে ভিকটিম হতাশ হয়ে পড়ে, তাকে চাপে রাখা হয়, একসময় আপস করতে বাধ্য করা হয়। এগুলো সব ঘটে রাজনীতির ছত্রছায়ায়। এই যদি অবস্থা তাহলে সমাজ ব্যবস্থায় অপরাধ বাড়বে বৈ, কমবে না। রাজনীতির মাধ্যমেই একটি দেশ শাসিত হয়, রাজনীতির মাধ্যমেই সরকার গঠিত হয়, দেশের উন্নয়ন হয়, কিন্তু রাজনীতি যদি অপরাধ ঘটানোর শক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে জনগণ সেই রাজনীতির দিকে অঙ্গুলি তুলবেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের তথাকথিত কিছু সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকের কারণে গোটা দেশের রাজনীতির ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন। রাজনীতিতে পরিশুদ্ধতা আনা রাজনীতিকদেরই দায়িত্ব।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।