২০০৪ সালে দক্ষিণ কোরীয় একটি চলচ্চিত্রের ডিভিডি হাতে আসে। স্প্রিং সামার ফল উইন্টার… এন্ড স্প্রিং। পরিচালক কিম কি দুক। দক্ষিণ কিংবা উত্তর কোনো কোরিয়ার ছবি এর আগে তেমন দেখা হয়নি। বিভিন্ন উৎসবে কয়েকটা দেখেছি, এইটুকুই। কিন্তু এই ছবিটি দেখে রীতিমত ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। বন্ধুদের অনেককেই দেখালাম ছবিটি। সবারই সে-একই অভিজ্ঞতা। নতুন এক পরিচালক কিম কি দুককে আবিষ্কার করলাম আমরা। আগ্রহী হয়ে উঠলাম দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র সম্পর্কে। যোগাযোগ হলো চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইনভেস্টরস ক্লাবের সঙ্গে শ্রদ্ধাভাজন চলচ্চিত্রকর্মী বিধান বড়ুয়ার মাধ্যমে। তারা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনিয়ে দিলেন দক্ষিণ কোরীয় ছবির প্রচুর ডিভিডি। যার মধ্যে কিম কি দুকের ছিল বেশ ক’টি। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে আয়োজিত হলো কয়েকদিনব্যাপী দক্ষিণ কোরীয় চলচ্চিত্র উৎসব চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র ও কোরিয়ান ইনভেস্টরস ক্লাবের যৌথ আয়োজনে। চট্টগ্রামের চলচ্চিত্রমোদীরা নতুন এক চলচ্চিত্র জগতের সন্ধান পেলেন। ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে কিম কি দুকের সাতটি ছবি নিয়ে আয়োজিত হয় রেট্রোসপেকটিভ, যার ফলে তাঁর নির্মিত সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়ার সুযোগ হয়। কিম কি দুক যেমন নতুন করে ধরা দিলেন আমাদের কাছে এবং তাঁর সূত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমাও অবাক বিস্ময়ে উপস্থাপিত হলো আমাদের চোখের সামনে। একই অভিজ্ঞতা বিশ্ব চলচ্চিত্রের চলচ্চিত্রামোদীদের বেলাতেও। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা অনেক আগে থেকেই কৌলিন্য অর্জনে সক্ষম ছিল এবং চলচ্চিত্র বিশ্বে পরিচিতও ছিল, তবে তা গৌরবের মহিমায় সমাদৃত হয়ে ওঠে কিম কি দুকের চলচ্চিত্রের সূত্রে। এই গৌরবের সাম্প্রতিক উত্তরাধিকার বংজু মুনের প্যারাসাইট।
অবিভক্ত কোরিয়ায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯২৩ সালে। অর্থাৎ আমাদের অবিভক্ত বাংলার অনেক পরে এবং পূর্ববঙ্গের প্রায় সমসময়ে। কিন্তু আজ তাদের চলচ্চিত্র রীতিমত শীর্ষস্থানে। আর আমরা শেষের পথে। ১৯৬০-এর দশকে দুই কোরিয়ার চলচ্চিত্রে মেধাবীদের আগমন ঘটে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও বৃদ্ধি পায়। তরুণ মেধাবী অনেক নির্মাতার উত্থান ঘটে। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশককে কোরীয় চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ বলা হয়। উঠে আসেন কি কি ইয়াং, ইউ হায়ান মক, শিন সাঙ ওক, ইন কোন তায়েক-এর মতো প্রতিভাবান নির্মাতা ইন কোন তায়েক এর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র বিশ্বসমক্ষে আসে ১৯৮১ সালে মান্দালা ছবিটির সূত্রে। সেই অগ্রযাত্রা বলতে গেলে আর থামেনি।
এই ধারাবাহিকতায় উজ্জ্বল উত্থান ঘটে এক প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারের। কিম কি দুক। ক্রমশ যিনি হয়ে ওঠেন দক্ষিণ কোরিয়ার নন, পুরো কোরিয়ার চলচ্চিত্রের প্রধান পুরুষে। তাঁর ভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্রিক নির্মিতির বৈশিষ্ট্য সিনেমার দুনিয়ায় তাঁকে স্বতন্ত্র একটি মর্যাদা এনে দেয়। আর এটা ঘটে তাঁর নবীন বয়সে। মাত্র ৫৯ বছর বয়সে যখন তিনি প্রয়াত হলেন তার অনেক আগেই ফিল্ম মায়েস্ত্রোতে পরিণত। ততদিনে তিনি নির্মাণ করেছেন ২২টি চলচ্চিত্র। যদিও অতিরিক্ত যৌনতা, অশ্লীলতা, ভায়োলেন্স এবং নারীত্বের অবমাননার অভিযোগে বারবার তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন দেশে বিদেশে কিন্তু দর্শক ও সমালোচকেরা কেউই তাঁর চলচ্চিত্রকে অস্বীকার করতে পারেনি। আবার উল্লেখিত বিষয়ের বিপরীতে গিয়ে জীবনের সৌম্য শান্ত সমাহিত দিক নিয়েও অসাধারণ ছবি তৈরি করেছেন যার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন স্প্রিং সামার ও পিয়েতা। বিশেষ করে স্প্রিং সামার ফল ডইন্টার এন্ড স্প্রিং প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর সমান্তরালে জীবনের বিভিন্ন দিক ও অনুভূতিকে কিম এই ছবিতে উপস্থাপন করেছেন একজন শিক্ষানবীশ বৌদ্ধ শ্রমণ, একজন আশ্রয়হীনা তরুণী, একজন সন্ন্যাসী, একজন শিশু ও একটি বৌদ্ধ মঠের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে। বৌদ্ধ দর্শনের প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের মর্মার্থকে উপজীব্য করে তুলেছেন কিম তাঁর এই অনিন্দ্য সুন্দর চলিচ্চত্রে। নিঃসন্দেহে বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক অপরূপ সৃষ্টি কিমের এই চলচ্চিত্র, যাকে তিনি উত্তীর্ণ করে যেতে পারেননি, যদিও এর আগে ও পরে দুর্দান্ত সব চলচ্চিত্র তিনি নির্মাণ করেছেন। স্প্রিং সামার ও পিয়েতা অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিল বিদেশি চলচ্চিত্র বিভাগে। পিয়েতাও ভেনিসে সেরা ছবির পুরস্কার পায়। কিন্তু অস্কার ‘অধরা’ থেকে যায় কিমের জীবনে। বিশ্বের অনেক প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকারের কপালে জীবন সায়াহ্নে এই পুরস্কার জুটেছে। কিন্তু কিম চলে গেলেন অল্প বয়সে, যে বয়সটি একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে একই সাথে স্বল্প ও উর্বর। বলতে গেলে জীবনের শীর্ষ সময়।
১৯৬০ সালের ২০ ডিসেম্বর কিম কি দুকের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার বোংগোয়া-গুণ শহরের এক দরিদ্র পরিবারে। অর্থকষ্টের কারণে খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। শৈশব থেকেই আঁকাআঁকিতে সহজাত প্রতিভা ছিল। কিন্তু কোনো প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি। অনেক পরে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৯০ থেকে ৯৩ চার বছর প্যারিসে চারুকলায় পড়াশোনা করেন। তবে এ-সময় তিনি চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরে তিনি বিভিন্ন পরিচালকের চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। তৈরি হতে থাকেন। ১৯৯৬ সালে নির্মাণ করেন প্রথম চলচ্চিত্র ‘ক্রোকোডাইল’। প্রথম ছবিতে নিজের জাত চিনিয়ে দিতে সক্ষম হন কিম। ২০০০ সালে দ্য আইল ছবির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি প্রশংসা ও পরিচিত অর্জনে সক্ষম হন। এরপর কিম তৈরি করলেন ব্যাড গাই, স্প্রিং সামার, থ্রি আয়রন, সামারিটান গার্ল দিবো, টাইম, ব্রেথ, আরিরাং, পিয়েতা, মোবিয়াসসহ আরো কিছু ছবি। বিষয়বৈচিত্র্য ও নির্মাণ আঙ্গিকের বিচারে প্রতিটি চলচ্চিত্রই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। যেসব অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে ছিল তার প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছেন, মানুষের বিভিন্ন রিপু ও ইন্দ্রিয়ের অবদমনের চিত্র, মানবমনের অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র এবং ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার নানা ভণ্ডামি ও ভোগের চিত্র তিনি তাঁর চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন। কিমের প্রায় সবকটি ছবি বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত। যার মধ্যে কান, বার্লিন, ভেনিস অন্যতম। বিশ্ব চলচ্চিত্রে ক্রমশঃ গুরুত্বপূর্ণ একজন চলচ্চিত্রকারে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু করোনার মরণ ছোবল তাঁর সেই অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিল ভয়ংকর ২০২০-এর ১১ ডিসেম্বর । দক্ষিণ কোরিয়ার ভোগসর্বস্ব জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি লাটভিয়ার এক গ্রামে স্থিত হতে চেয়েছিলেন। জন্মভূমি থেকে অনেক দূরের সেই দেশে জন্মমাস ডিসেম্বরে ৬০ তম জন্মদিনের ৯ দিন আগে মৃত্যুতেই স্থিত হলেন কোরিয় সিনেমার মায়েস্ত্রো কিম কি দুক।