চৌচালা টিনের ঘরের দাওয়ায় বসে প্রতিদিন চেয়ে থাকি গাঁয়ের মেঠোপথে। বাবা আসবেন। সবার বাবারা ঘরে ফিরে সাঁঝের বেলায়। আমার বাবা তেমন নয়। আমার উর্দিপরা বাবা বাড়ি আসেন বছরে এক কি দু’বার। কখনো এ-আসা সাত দিনের কখনো বা মাসখানেকের জন্য। বাদবাকী সময় আমি অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকি মেঠোপথে, আমার বাবার আসার প্রতীক্ষায়। আমার জ্যাঠাজি, বাবার বড় ভাই। রোজ সকালে কাজে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরেন।
তিন জ্যাঠাতো ভাইবোনেরা দৌড়ে গিয়ে তাদের বাবাকে জড়িয়ে ধরে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে কিছু না কিছু বের করে বিলিয়ে দেন সন্তানদের। দূর থেকে প্রতিদিন এ দৃশ্য দেখে আমার চোখে জল আসে। অভিমান হয়। বাবা কেন রোজ ফেরে না! ছ’বছরের ছোট্ট শরীরটা বুঝতেই চাইতো না বাবা যে অন্য বাবাদের মতো নন।
বাবার আসতে গেলে ছুটি লাগে। ছুটিতে বাবার আসার সময় হলে আমি বাড়ির বেড়া দেয়া প্রাচিরের দরোজার বাইরে গিয়ে ঠাঁয় বসে থাকি। গাঁয়ের বাঁকা পথ ধরে আমার উর্দিপরা সামরিক বাবা যখন ঝড়ো হাওয়ার মতো ছুটে আসেন, আমি দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বাবার ঘ্রাণ আর উর্দির ঘ্রাণ মিলেমিশে এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়ায়। আমি চোখ বন্ধ করে সেই অনুভূতি হৃদয়ে মেশাই।
আমার তখন খুব চিৎকার করে গাঁয়ের ছেলে পুলেদের জানিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়, সবাই দেখে যাও আমার বাবা এসেছেন। গাঁয়ের লোকজন বরং এমনিতেই ছুটে আসে। উর্দি গায়ে বুটের আওয়াজ তুলে বাবার আসাটা গাঁয়ে কেমন করে যেন চাউর হয়ে যায়। অনেকেই পিছু নেয়। লোকজন আমাদের ঘরের দরোজায় জড়ো হলে, মা পাটি বিছিয়ে দেয় দাওয়ায়। বাচ্চা ছেলেপুলেরা গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়ায়। বাবা তার ব্যাগের পকেট চেন খুলে একমুঠো চকলেট বের করে দিলে, ছেলেপুলেদের সে কি আনন্দ!