কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা সত্য সাহার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | সোমবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ

উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা একটি প্রাচীন জনপদ। পূর্ব সীমানা চট্টগ্রাম শহরের শূন্য থেকে চট্টগ্রামরামগড় মহাসড়কের ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটারের মাইলফলক। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যথাক্রমে নন্দীরহাট, ইসলামিয়া হাট ও মদনহাট তিনটি প্রাচীন বাজার। পশ্চিমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর সড়ক এবং দক্ষিণে ধোপার দিঘিসংলগ্ন লোকনাথ আশ্রম সড়ক। এভাবে যে বর্গক্ষেত্রটি কল্পনা করা হলো সেখানে বিভিন্ন পাড়া, গ্রাম, বাড়ি নামে বিচ্ছিন্ন এবং সংলগ্ন আঠারোটি জনবসতি। যার আয়তন প্রায় চার বর্গকিলোমিটার। এ জনপদে হিন্দু,বৌদ্ধ ও মুসলমান তিন সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস।

উত্তরদক্ষিণে বিস্তৃত চট্টগ্রামরামগড় সড়ক এবং পশ্চিমে পাহাড়, মাঝখানে আবার চট্টগ্রামনাজিরহাট রেললাইন। আঠারোটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িই সড়কমহাসড়কের সঙ্গে গ্রামীণ সড়ক দিয়ে সুন্দরভাবে যুক্ত।

চট্টগ্রাম শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলা উত্তর ফতেয়াবাদ নন্দীরহাট এলাকা। নন্দীর হাটের নামকরণ হয়েছে এখানকার জমিদার বাড়ি এবং মন্দিরগুলোর কারণে। মূলত ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলে কয়েকজন জমিদার ছিলেন, যাদের প্রত্যেকের বাড়িতে মন্দির ছিল।

ইংরেজ আমলে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ফতেয়াবাদের বিখ্যাত নন্দী বংশের জমিদার কমলকান্তি নন্দী এই হাট প্রতিষ্ঠা করেন। একসময় নন্দী বংশের চাঁদ নন্দী ও বরদা নন্দী প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। শুরুতে এ হাট প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবারে বসত। বর্তমানে এ হাট সপ্তাহে রবিবার ও বৃহস্পতিবার বসে। নন্দীরহাটের নিকট নন্দীর দিঘি প্রাচীন দিঘি। দিঘির পশ্চিম পাড়ে বেশ উঁচু মঠ ছিল। মঠটি ২০১১ সালে সংস্কার করা হয়। কার্যত নন্দীর হাট এলাকাটি হিন্দু জমিদার অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিলো; পশ্চিমে লক্ষ্মী সাহা, উত্তরে প্রাণ হরি রক্ষিত, পূর্বে চাঁদ নন্দী।

নন্দীরহাট এলাকায় শ্রী লক্ষ্‌মীচরণ সাহার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি হলো কিংবদন্তিতুল্য বাড়ি। ১৮৯০ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় নন্দীরহাটে ৫ একর জায়গার উপর নির্মিত হয় এই জমিদার বাড়িটি। বাড়িটি নির্মাণ করেন জমিদার লক্ষ্‌মীচরণ সাহা। তবে জমিদারি চালুর পেছনে মূলত তিনজন রয়েছেন। তারা হলেন শ্রী লক্ষ্‌মীচরণ সাহা, মাদল সাহা ও নিশিকান্ত সাহা। এই জমিদার বাড়ির শেষ জমিদার ছিলেন জমিদার লক্ষ্‌মীচরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন সাহা।

এই জমিদার বাড়িতেই ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক, একুশে এবং স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত সত্য সাহা। ১৯৪৬৪৮ মাঝামাঝি সময়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৫১ ও ১৯৫২ সালে কলকাতার একটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। সত্য সাহারা ছিলেন ১২ ভাই। ঐসময় এ বাড়িতে প্রায় ১০০ কর্মচারী ছিল।বাড়িটিতে নানা কারুকাজখচিত দুটি বাসভবন, একটি দ্বিতল বিশিষ্ট কাচারি ঘর, একটি মন্দির, তিনটি পুকুরসহ ফসলি জমি ও গাছগাছালির বাগান রয়েছে। ঐতিহাসিক এই বাড়িটিতে একসময় সিনেমার শুটিংও হয়েছে।

১৯৫৫ সালে সত্য সাহা প্রথম সিনেমা ‘সুতরাং’এর মাধ্যমে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। ১৮ দিন ধরে সিনেমাটি এই জমিদার বাড়িতে চিত্রায়িত হয়েছিল। সত্য সাহার প্রযোজনায় ১৯৭৫ সালে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার দৃশ্যধারণও হয় এই বাড়িতে।

বাংলা গানকে এগিয়ে নিতে যাদের অবদান অনেক তাদের অন্যতম এক নাম সত্য সাহা।

তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির মধ্যে আছেনীল আকাশের নিচে আমি, চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা, দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক, চিঠি দিও প্রতিদিন, আমার মন বলে তুমি আসবে, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, তুমি কি দেখেছো কভু, ঐ দূর দূরান্তে, আমি যে আঁধারে বন্দিনী, তোমারই পরশে জীবন আমার, মাগো মা ওগো মা, অথই জলে ডুবে যদি মানিক পাওয়া যায় ইত্যাদি।

কিংবদন্তি সংগীতস্রষ্টা সত্য সাহা তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৪ সালে আগুনের পরশমণি, ১৯৯৬ সালে অজান্তে এবং ২০০১ সালে চুড়িওয়ালা চলচ্চিত্রের জন্য। ২০১৩ সালে সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।

সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং সিনেমার মাধ্যমে ১৯৫৫ সালে সংগীত পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার। এরপর একে একে কাগজের নৌকা, গুনাই বিবি, অপরিচিতা, বাঁশরী, চেনাঅচেনা, এতটুকু আশা, আগুনের পরশমণি, অজান্তে, চুড়িওয়ালা, মোমের আলোসহ প্রায় ৯০টি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি।

১৯৯৯ সালের ২৭ জানুয়ারি সত্য সাহা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলে সুমন সাহা এবং ছোট ছেলে ইমন সাহা সঙ্গীতশিল্পী। জমিদার বাড়িটি বর্তমানে দেখভাল করছেন জমিদার বাড়ির বংশধর, সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা ননী গোপাল সাহা এবং রাঙামাটি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বপন কুমার সাহা।

বলা বাহুল্য, হাটহাজারীর নাজিরহাট, ধলই, গুমানমর্দন, চারিয়া, জোবরা, আলীপুর, ফতেয়াবাদসহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল তাদের জমিদারি। এসব অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার কৃষক প্রতিবছর খাজনা দিতে আসতেন এই বাড়িতে। নিয়মিত রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠান হতো। জমিদার প্রসন্ন কুমার সাহার দুটি ঘোড়ার গাড়ি ছিল। তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আদালত ভবনে যেতেন। দুইজন নেপালি দারোয়ান সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকতেন। জমিদার বাড়ির পাশে গোশালায় ছিল নয় জোড়া হালের গরু। ছিল গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছ। একেক বেলায় রান্না হতো প্রায় দুইতিনশ লোকের। সবকিছুই এখন ইতিহাস।

প্রাচীন ঐতিহ্য সম্বলিত এই বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। বাড়িটির চারদিকে রয়েছে ফসলি জমি, গাছগাছালি ও তিনটি পুকুর। এ ছাড়া আছে একটি দোতলা কাচারি ঘর, একটি বিগ্রহ মন্দির ও দুইটি বাসভবন। দৃষ্টিনন্দন এ জমিদার বাড়িটি কালের প্রবাহে জরাজীর্ণ হলেও এর ভাবগম্ভীর ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য এখনো বিদ্যমান। জমিদার ভবনের দেয়াল ও কার্নিশগুলো নানা কারুকাজে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। কাঠের ছাদের বাড়িটির দুই পাশে আছে দুটি গম্বুজ।

১৯৫০ সালের দিকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর ওই বাড়িটি পূর্বের জৌলুস হারায়। সেইসব দিনের ইতিহাস, ঐতিহ্য বহনকারী জমিদার বাড়িটি অবহেলায় পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে হয়তো বাড়িটি বিলীন হয়ে যাবে একদিন। হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের খ্যাতিমান সুরকার এবং সংগীত পরিচালক সত্য সাহার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বাড়িটি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাক্তপীঠ চন্দ্রনাথ
পরবর্তী নিবন্ধআশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তামাকের কালোবাজার