কাল আজ কাল

প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে পাঠাগার গড়ে তোলা হোক

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২ জুন, ২০২২ at ৪:১৯ পূর্বাহ্ণ

দেশে বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৭১টি। স্থানীয় সরকারের প্রাথমিক স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ। এটি একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান। আজকের ইউনিয়ন পরিষদ ইউনিয়ন বোর্ড হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল ব্রিটিশ আমলে।

তবে বৃটিশদের আগমনের আগেও অধিকাংশ গ্রামে পঞ্চায়েত প্রথা প্রচলিত ছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন। জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক প্রয়োজনে পঞ্চায়েত প্রথার উদ্ভব ঘটে। তাই এগুলোর আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না। বৃটিশ শাসনামলে অর্থনৈতিক প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কারণে এবং পল্লী অঞ্চলে বৃটিশদের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করার জন্য লর্ড মেয়ো ১৮৭০ সালে চৌকিদারী আইন পাশ করেন। এর ফলে প্রথমবারের মত পল্লী অঞ্চলে আইনগত ভিত্তির মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের উদ্ভব হয় এবং পঞ্চায়েত প্রথার বৈধতা পায়। চৌকিদারী পঞ্চায়েতের সদস্য সংখ্যা ছিল পাঁচ জন এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পঞ্চায়েতের সকল সদস্যকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ করতেন। এরপর ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ইউনিয়ন কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৫৯ জন। তাঁরা গ্রামবাসী কর্তৃক নির্বাচিত হতেন এবং ইউনিয়ন কমিটির পাশাপাশি চৌকিদারী পঞ্চায়েতেও জড়িত থাকতেন। এর ফলে তৃণমূলে দ্বৈত শাসনের অসুবিধা দেখা দেয়। ফলে ১৯১৯ সালে বঙ্গীয় পল্লী স্বায়ত্বশাসন আইনের অধীনে চৌকিদারী পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য ১/৩ অংশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক মনোনয়ন দান করতেন। অবশিষ্ট সদস্যগণ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতেন। সদস্যগণ তাদের মধ্য থেকে প্রেসিডেন্ট ও একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতেন। কার্যকাল ছিল ৩ বছর। পরে ১৯৩৬ সাল হতে ৪ বছর করা হয়। মনোনয়ন প্রথা ১৯৪৬ সালে রহিত করা হয়।

পাকিস্তান আমলে ‘মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ১৯৫৯’ এর অধীনে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হয় এবং সদস্য সংখ্যা করা হয় ১০১৫ জন। মোট সদস্যের দুই তৃতীয়াংশ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতেন এবং বাকি এক তৃতীয়াংশ মহকুমা প্রশাসক সরকারের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দান করতেন। ১৯৬২ সালে মনোনয়ন প্রথা রহিত করা হয়। সদস্যগণ তাদের মধ্য থেকে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। পরবর্তীতে ভাইস চেয়ারম্যানের পদটি বিলুপ্ত করা হয়। ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেয়াদ ছিল ৫ বছর।

১৯৮৩ ও ১৯৯৩ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ অনুয়ায়ী প্রত্যক্ষ ভোটে একজন চেয়ারম্যান ও ৯ জন সাধারণ সদস্য এবং সংরক্ষিত আসনে ৩ জন মহিলা সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদকাল৫ বছর। ইউনিয়ন পরিষদের বাধ্যতামূলক কাজ ১০টি এবং ঐচ্ছিক কাজ ৩৮টি। সে কাজগুলো কী কী তা এখানে বিশদ তুলে ধরার সুযোগ নেই এবং প্রয়োজনও নেই কারণ বাংলাদেশের মানুষমাত্রই সে বিষয় যথেষ্ট ওয়াকেবহাল। আমি শুধু আজকের লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়টি তুলে ধরি।

ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলীর তালিকায় একেবারে শেষের দিকে আছে, ‘ইউনিয়ন পরিষদ মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে। উন্নয়নমূলক কাজ ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ কিছু সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাঠাগার স্থাপন। ইউনিয়ন পরিষদ ইউনিয়ন কমপ্লেঙে পাঠাগার স্থাপন করবে। বয়স্কদের জন্য নৈশ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করবে। চিত্ত বিনোদনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ জাতীয় উৎসবের দিনগুলো উদযাপন, মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন, খেলাধুলা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান, মাঠ ও উদ্যানের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করবে’।

অর্থাৎ কাজের তালিকায় পাঠাগার স্থাপন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করার কথাও উল্লেখ আছে। তবে আমার ধারণা এবং গ্রামের সঙ্গে সংযোগ আছে এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম ইউনিয়ন পরিষদ বর্তমানে অনেক কাজ করলেও এই দুটি ক্ষেত্রে তাদের উৎসাহ শূন্যের কোঠায়।

অথচ মানুষকে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে আলোকিত করা এবং তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উদ্ভুদ্ধ করা যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

গত দেড়দুই দশক বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনীতির চেহারাই শুধু পাল্টায়নি, অবকাঠামোগত দিক দিয়ে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে দেশে। এ উন্নয়ন শুধু শহরকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ থাকেনি, গ্রামও আমূল পাল্টে গেছে উন্নয়নের ছোঁয়ায়। আগের জরাজীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ ভবন এখন কোথাও নেই। অনেক বড় জায়গা জুড়ে চাকচিক্যময় বহুতল ভবনে চলে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। এখন ইউনিয়ন পরিষদের কাজের পরিধি বেড়েছে, চাপ বেড়েছে, বাজেট বেড়েছে। বছরে কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করতে হয় চেয়ারম্যানমেম্বারদের।

গ্রামে সড়ক হচ্ছে, কাঁচা সড়ক পাকা হচ্ছে, স্কুল, কলেজ, মসজিদমাদরাসায় নতুন নতুন ভবন হচ্ছে, ব্রিজকালভার্ট হচ্ছে অর্থাৎ উন্নয়নের প্রায় সবগুলো সূচকে এগিয়ে থাকছে কিন্তু একটি বিষয়ে মনে হয় পিছিয়ে আছে আর তা পূর্বেও আলোচনা করেছি। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকৃত উন্নয়ন নয়। প্রকৃত উন্নয়ন হলো মানবিক উন্নয়ন। আর তার জন্য প্রয়োজন সমাজে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া। আর এই কাজটি তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করা যায় ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে। যেমন, বিশাল স্থাপনাসমৃদ্ধ প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা। এটি ইউনিয়ন পরিষদের অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজের তালিকায় রাখতে হবে। পাঠাগারে পর্যাপ্ত পরিমাণ বইপত্রিকাসাময়িকী রাখার সঙ্গে সঙ্গে একজন পাঠাগারিকও নিয়োগ দিতে হবে। ইউনিয়নের গণমান্য ব্যক্তি, শিক্ষক এবং সে ইউনিয়নে কর্মরত সরকারি কর্মচারিকর্মকর্তাদের যুক্ত করতে হবে পাঠাগারের সঙ্গে। খুব ভালো হয় অন্তত এ ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে সম্পৃত না করলে। পাঠাগারে বসে বইপড়ার সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বই নিয়ে পড়ার সুযোগও দিতে হবে। এলাকার বাসিন্দাদের পাঠাগারে আসতে এবং এর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহী করে তুলতে হবে। প্রতিবছর একটি ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে যত টাকার কাজ হয় সে তুলনায় একটি পাঠাগারের জন্য সামান্য অর্থব্যয়ে রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে বরং একটি অশিক্ষিত, অজ্ঞানী কূপমণ্ডূক একটি জাতি গড়ে উঠলে।

পাঠাগার আন্দোলনের অংশ হিসেবে এই কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নামকাওয়াস্তে অখ্যাত কিছু লেখকের বই দিয়ে পাঠাগার করলে হবে না। বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করেন এমন লেখকদের বইকে প্রাধান্য দিতে হবে। মানুষের মননশীলতা ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে এমন সব বই রাখতে হবে। একটি উদার, অসামপ্রদায়িক জাতি গড়ে তুলতে সহায়ক এমন বই দিয়ে পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করতে হবে। সমাজে ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বইসাময়িকী যেন রাখতে না পারে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। প্রয়োজনে বই কেনা ও রাখার বিষয়ে একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করা যেতে পারে। প্রতিটি পাঠাগারকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র পাঠচর্চাকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। পাঠাগারকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নের সবকটি গ্রামে সংস্কৃতিচর্চা বেগবান করতে হবে। অর্থাৎ একটি শিক্ষিত ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাঠাগারকে কাজে লাগাতে হবে।

শিক্ষা পদ্ধতিতে কাজে লাগিয়ে সিঙ্গাপুর আজ এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ। শিক্ষাসংস্কৃতিকে কাজে লাগিয়ে কেরালা আজ ভারতের সবচেয়ে অগ্রসর রাজ্য। কাজেই আমাদেরও সে পথে চলতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগই হচ্ছে সবচেয়ে লাভজনক ও টেকসই বিনিয়োগ। পাঠাগার আন্দোলনকে শিক্ষা আন্দোলনের অংশ করে তুলতে হবে। তাতেই জাতির সর্বতো মঙ্গল নিহিত বলে ধরে নিতে হবে।

লেখক : কবি সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীজন্মই একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র
পরবর্তী নিবন্ধডায়াবেটিস বিষয়ে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কার