কাল আজকাল

সন্তানদের কোন্‌ সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছি আমরা

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৪ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ফায়ার গেমসে আসক্ত হয়ে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে গাজীপুরের ছয় বছরের শিশু রাফিয়া মুনতাহা। পরে নিজেই আবার আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এতে তার শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে। শিশুটি এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তার মা জিন্নাত জাহান সংবাদমাধ্যমকে জানান, তার মেয়ে নিজে নিজেই সার্চ করে ঘরের স্মার্টটিভি ও স্মার্টফোনে বিভিন্ন ওয়েব সিরিজের কার্টুন দেখে থাকে। সেখানে ফায়ার গেমসসহ অন্যান্য আরও অনেক কার্টুন দেখে থাকে। সে সব ওয়েব সিরিজের কার্টুনগুলোতে দেখা যায় নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আবার নিভিয়ে ফেলে। কার্টুন তো কার্টুনই। ছোট শিশু না বুঝে সেসব কার্টুন দেখে চুলার সামনে গিয়ে তার শরীরের সুতির জামার এক অংশ তার দুই হাত দিয়ে ধরে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে আবার নেভানোর চেষ্টা করে কিন্তু নেভাতে পারে না। দাউ দাউ করে শরীরে আগুন ধরে যায়। পরে বাসার লোকজন তাকে জাপটে ধরে আগুন নিভিয়ে ফেলে। ততক্ষণে তার শরীরের অনেক অংশ পুড়ে যায়। রাফিয়া মুনতাহা নামের শিশুটি গাজীপুর নবারন বিদ্যাপীঠ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্লেতে পড়াশোনা করে।

বার্ন ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক সূত্রে জানা গেছে, শিশুটির শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

গাজীপুরে সংঘটিত হলেও সংবাদটি উদ্বেগজনক। আমাদের শিশুরা কেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে, তারা কী দেখে, কী শিখে বড় হচ্ছে তা এখন গভীরভাবে ভাবাচ্ছে অভিভাবক ও সচেতন মহলকে। এই ঘটনাটি একটি সতর্কবার্তা দিচ্ছে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক করুণ পরিস্থিতির। কিন্তু তাতে কি আমরা কর্ণপাত করছি? ছয় বছরের একটি শিশুর হাতে আমরা স্মার্ট ফোন তুলে দিয়েছি (আসলে সেটা তার মা অথবা বাবার)। স্মার্ট টিভিতে সার্চ করে গেম দেখার সুযোগ করে দিয়েছি বা তার আব্দার মিটিয়েছি। এটার মধ্য দিয়ে এই শিশুর মনোজগৎকে আমরা কী অন্ধকার ও বিভ্রান্তির মুখে ঠেলে দিয়েছি। যখন শিশুর জন্য একটি খোলা আকাশের দরকার, প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে উঠবার সময় তখন তার হাতে মোবাইল ও টিভির রিমোট ধরিয়ে দিয়েছি। আসলে আমরা বাবামায়েরা শিশুদের শিশুকালকেই হত্যা করেছি। আর এটা করতে গিয়ে শিশুদের ঠেলে দিয়েছি এক বিপজ্জনক ভবিষ্যতের দিকে। এটার দায় আমরা অভিভাবক এবং একই সঙ্গে সমাজবিদদেরকেও নিতে হবে। কারণ সময় থাকতে সতর্ক না হলে ভবিষ্যৎ আরও ভয়াবহ হতে পারে।

এর পরিণতিতে সমাজে কী ঘটছে! ২০১৭ সালে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার করা গোপনীয় এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাজধানী ও এর আশেপাশে কিশোরতরুণদের ১২টি গ্রুপ মেয়েদের উত্ত্যক্ত, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক সেবন, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা এলাকাভিত্তিক এসব গ্রুপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশপাশের এলাকায় সক্রিয় আছে। এসব গ্রুপে অছাত্রও আছে অনেক। প্রতিবেদনে, ঢাকার ১২টিসহ সারাদেশে এমন ৩৫টি গ্রুপের কথা বলা হয়েছে। কয়েকবছর আগে ঢাকার উত্তরা ও তেজগাঁওয়ে দুই কিশোর আদনান কবির ও আল আমিন খুনের পর কিশোর অপরাধ বিষয়টি আলোচনা উঠে আসে। এর কিছুদিন পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রাম নগরীর ১৬ থানা এলাকায় দুই শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচশর বেশি সদস্য সক্রিয় রয়েছে। অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব কিশোরদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের সন্তানরাও রয়েছে। এমনকি বাদ যায়নি পথ শিশুরাও। বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চলছে তাদের অপরাধযজ্ঞ। যার পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে কথিত ‘বড় ভাই’। অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোররা রাজনৈতিক কথিত বড় ভাইয়ের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

এ বছরের ২২ মার্চ শুক্রবার একট দৈনিকে প্রকাশিত খবর বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম নগরে এখন সক্রিয় রয়েছে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। নগরজুড়ে এদের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। নগর পুলিশের ১৬টি থানা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাং পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাই’। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে খুনোখুনি থেকে শুরু করে জায়গা দখল, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারামারি, অস্ত্রবাজি, উত্ত্যক্তসহ নানা অপরাধে জড়িয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এদের বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। নামে কিশোর গ্যাং হলেও দলে ২০ থেকে ৩২ বছর বয়সীরাও রয়েছেন। রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং। বেশির ভাগ বাহিনীর সদস্য ১০ থেকে ৫০ জন।

ঢাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছিল, তার চেয়ে এখন পরিস্থিতি খারাপ। যেমন পুলিশের তালিকার বাইরে ঢাকায় আরও অন্তত ১৪টি কিশোর গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে।

বাহিনীগুলো শুধু অপরাধই করে না, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টির কিশোর গ্যাং সংশ্লিষ্ট।

৩। বয়ঃসন্ধিক্ষণে অনেকের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এ সময়ে সঠিক শিক্ষা না পেলে যে কারো বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া উঠতি বয়সের বা তারুণ্যের একটি উদ্দামতা থাকে। অনেক সময় অ্যাডভেঞ্চার বা হিরোইজমের বশেও অনেক কিশোর তরুণ বিপথে পরিচালিত হয়ে থাকে।

এ সময় তারা পড়াশোনায়ও অমনোযোগী হয়ে পড়ে। এই ধরনের কিশোরতরুণরা আসে সাধারণত দু’ধরনের পরিবার থেকে। ধনী পরিবারের সন্তান এবং যে সব পরিবারে মাবাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক কম, অর্থাৎ যাদের সন্তানের সাথে বাবামায়ের দূরত্ব আছে তেমন পরিবারের সন্তানরাই সাধারণত এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, গরিব ও শ্রমজীবী পরিবারের অনেক সন্তান রাগ, ক্ষোভ হতাশা থেকেও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আবার আমি এমন আদর্শ পরিবারও দেখেছি যে পরিবারের সন্তান মাদকাসক্ত হয়েছে ওপরে বর্ণিত কারণগুলো বিদ্যমান না থাকা সত্ত্বেও। এসব ক্ষেত্রে বাবামায়েরা সন্তানের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে থাকেন। সন্তানরা বাবামাকে উৎপীড়ন করে। কারণ তারা জানে, এ ক্ষেত্রে বাবামা অসহায়। এমন পরিবারের বাবামায়েরা সন্তানের কথা ভেবে, পরিবারের মানসম্মানের কথা ভেবে সন্তানের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার কথা কারো নিকট প্রকাশও করতে পারেন না।

জীবন সম্পর্কে এদের যথেষ্ট জানাশোনা না থাকায় এরা চটজলদি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এবং তা খুনোখুনির মতো নির্মম ঘটনার বেলায়ও। এরা অপরিণামদর্শী, অদূরদর্শী। এটি আমাদের নগরায়ণের কুফল বলে বলা হলেও এমন দৃশ্য গ্রামেগঞ্জেও কম নয়। সমস্যা হচ্ছে এদের হাত থেকে এদের মায়ের বয়েসী নারীও রক্ষা পায় না। এরা ক্রমে ক্রমে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার পর নেশার খরচ যোগাতে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সচ্ছল, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তান ছাড়াও পথশিশুদের মধ্যে এই প্রবণতা ভীষণ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

এ ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দ্রুত বের করতে না পারলে সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে এবং তাতে সমাজ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। কাজেই প্রশাসন ও এদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। আগে আমাদের পাড়ামহল্লায় সর্দারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ছিল। পাড়ায়পাড়ায় এ ধরনের কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। পাড়ার মধ্যেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা ছিল। পাড়ার কোনো ছেলে এ ধরনের কাজে যুক্ত হয়ে পড়লে তার জন্য সালিশবিচার হতো, দোষী তরুণের পরিবারকে তার দায় নিতে হতো। এখন পাড়ায় পাড়ায় সেই সমাজবদ্ধতা নেই। কেউ কারো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। আর নতুনভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকায় কে কোথা থেকে এসেছে তার খবর কেউ রাখে না। ফ্লাটের মধ্যে সীমিত সবার জীবন।

বিষয়টিকে শুধু ভাবনার এবং সমস্যার মধ্যে রেখে দিলে চলবে না। এখন থেকে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। কাজেই এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং ও কাউন্সিলিং করতে হবে। সমাজের আলোকিত, আলোচিত ভালো মানুষদের যুক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যে কোনো অপরাধী অপরাধ করার আগে একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআ’লে রসুল গাউছুল আযম বাবা ভাণ্ডারী
পরবর্তী নিবন্ধউরকিরচর ইউনিয়নে নববর্ষ উদযাপনে প্রস্তুতি সভা