গত শতকের আট ও নয় দশকের সময়ে চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের ব্যবসার গতি–প্রকৃতি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। খাতুনগঞ্জের পোস্ট অফিস গলি, আমিন মার্কেটে তখন পুরনো কাপড় আমদানিকারকদের রমরমা ব্যবসা। আমার মেঝ ভাই সে ধরনের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন। তখন ইনডেন্টিং ব্যবসা খুব জমজমাট ছিল। আধা কিলোমিটার হাঁটলেই অন্তত পঞ্চাশটি ইনডেন্টিং ফার্মের সাইনবোর্ড চোখে পড়ত। অনেককে দেখতাম শুধু একটি ব্রিফকেস হাতে নিয়ে ঘুরছেন। জিজ্ঞেস করলে পরিচয় দিতেন, ইনডেন্টিং ফার্মের মালিক।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এই ব্যবসাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ইনডেন্টিং ফার্মের কাজটি ছিল মূলত মধ্যস্থতা করা। আমদানিকারকের সঙ্গে রফতানিকারকের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে একটি কমিশন ভোগ করা। আমদানিকারকদের খুব চাপ নিতে হতো না। পণ্য কখন, কীভাবে বন্দরে আসবে সেসব দেখভাল করতো ইনডেন্টর। কোন দেশ কোন পণ্য রফতানি করে, কোন দেশে দাম কম, কোন দেশের পণ্যের মান ভালো সেসবের খোঁজ দিতো ইনডেন্টররা। আর চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ–আছদগঞ্জের আমদানিকারকরা তা আমদানি করতেন। অধিকাংশ সময়ে দেখা যেত, বেশ কয়েকজন একত্রিত হয়ে কোনো পণ্য আমদানি করছেন। কখনো একই পণ্য যার যার সক্ষমতা অনুয়ায়ী আমদানি করছেন। যার যাঁর আমদানি করা পণ্য তাঁর তাঁর তত্ত্বাবধানে বিক্রি হচ্ছে। একই পণ্য অনেকে আমদানি করতেন বলে এককভাবে কেউ দাম বাড়িয়ে দিতে পারতেন না। কেউ মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকটও তৈরি করতে পারতেন না। তারপরও যে সে সময় পণ্য মজুত করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা হয়নি তা বলা যাবে না। তবে তা হঠাৎ ঘটতো। বর্তমানের মতো নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল না। চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের ব্যবসা ছিল পুরোটা পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর। কোটি কোটি টাকা লেনদেন হতো শুধুমাত্র মুখের কথায়। একটা ডিও, সেটাই হাত বদল হতো টাকার বিনিময়ে। সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ওপর হাজার কোটি টাকা লেনদেনের এই বাজারে হঠাৎ বিপর্যয় নেমে আসে টাকা নিয়ে দেশ ত্যাগের মতো কয়েকটি ঘটনার পর। অভিযোগ আছে এমন ঘটনা ঘটানোর নেপথ্যেও আছে কোনো কোনো গডফাদারের হাত।
গত শতকের শেষ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা এমনই ছিল। নতুন শতকে এসে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ভোগ্যপণের বিশাল চাহিদা ও বাজার আছে। তার অধিকাংশ আমদানি করতে হয়। আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ, উন্নত বীজ, যথাসময়ে সার ও কীটনাশক প্রাপ্তির ফলে ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও অন্যান্য অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়। সাড়ে শতের কোটি জনসংখ্যার এই দেশে তাই ভোগ্যপণ্য আমদানি বিশাল লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। কাজেই মিষ্টি যেখানে পিঁপড়াও সেখানে এই ফর্মুলায় দেশের উঠতি পুঁজিপতিদের অনেকেই ভোগ্যপণ্য আমদানি বাণিজ্যে যুক্ত হতে থাকে। তাঁদের অর্থের কোনো সমস্যা হয় না। কারণ তাদের বেশিরভাগই বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক, সরকারি ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা। শিল্প স্থাপনের চেয়ে তাদের কাছে ট্রেডিংটা লোভনীয় হয়ে ওঠে। ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পকারখানা গড়তে গেলে বাংলাদেশে অনেক বিড়ম্বনাও পোহাতে হয়। তাছাড়া শ্রমিক–কর্মচারীর বেতন–বোনাস নিয়েও মাঝেমধ্যে ঝামেলা! পোহাতে হয় বলে বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলো একটা–দুটা কারখানার আড়ালে মূলত ট্রেডিংয়েই মনোনিবেশ করে বেশি। এটা করতে গিয়ে আমদানিখাত পুরোটাই মুষ্টিমেয় কয়েকটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আগে ভোগ্যপণ্য আমদানি এবং পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রিত হতো চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের গদিতে বসা সওদাগরদের দ্বারা। একসময় তা বড় পুঁজির মালিক বড় আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের হাতে চলে যায়। এখন চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে কোনো ব্যবসা নেই। তা চলে গেছে ঢাকা–চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকার আলিশান কর্পোরেট হাউজগুলোর নিয়ন্ত্রণে। শুধু ঢাকা–চট্রগ্রাম নয় এখন সে ব্যবসা সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা ও দুবাই থেকেও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
যে কারণে এই মাসে চিনি কেলেঙ্কারি, পরের মাসে ভোজ্য তেল কেলেঙ্কারি, তারপরে পেঁয়াজ, আদা, ডিম, মুরগি, খেজুর, বুট, ডাল ইত্যাদি কেলেঙ্কারির ঘটনা লেগেই আছে। এসব পণ্য কারা আমদানি করে, কত দিয়ে বেচে, অথবা কেন না বেচে মজুদ করে রাখে তা সরকারের পক্ষে অজানা থাকার কথা না হলেও তাদের কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না। মাঝেমধ্যে নামধাম প্রকাশ হলেও তাদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারে না সরকার।
বর্তমানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। কেন বেড়েছে? পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ বলে। আমদানি বন্ধ কেন? পেঁয়াজচাষীদের ক্ষতির মুখ থেকে বাঁচানোর জন্য। ভালো কথা কিন্তু এটা করতে গিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়ালো তাকে কী বলা যাবে? ২৫/৩০ টাকার পেঁয়াজের দাম এখন নব্বই টাকা। ৬০ টাকা হওয়ার পর থেকে বাণিজ্যমন্ত্রী বারবার ভয় দেখাচ্ছিলেন, আমদানির অনুমতি দিয়ে দেব কিন্তু! এখন ৯০ টাকায় খাচ্ছি। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে শুনিনি।
কয়েকটি টেলিভিশন রিপোর্ট করতে গিয়ে পেঁয়াজচাষীর বক্তব্য নিয়েছে দেখলাম। সেখানে তাঁরা বলছেন, সরকার এখন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। রিপোর্টগুলো আমার কাছে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হয়েছে। কারণ পেঁয়াজ এখন আর কৃষকের ঘরে নেই। তা চলে গেছে আড়তদার তথা মধ্যসত্বভোগী তথা সিন্ডিকেটের হাতে। এখন আমদানি যত দেরি হবে তত লাভ হবে এই সিন্ডিকেটের। কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ রাখতে না পারার দুটো কারণ আছে, প্রথমত হলো, আর্থিক কারণ। এতদিন উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না করে ঘরে রাখার বা ধরে রাখার মতো আর্থিক সচ্ছলতা তাদের নেই। উৎপাদন ব্যয় নির্বাহের জন্য তাদের ধারকর্জ করতে হয়, অনেকসময় দাদন নিতে হয় ফলে ফসল তোলার পরপরই তাদের লক্ষ থাকে দেনা শোধের। দ্বিতীয়ত এবং গুরুত্বপূর্ণ যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে তা হলো পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা। এই একটি সমস্যার সমাধান করা গেলে পেঁয়াজ আমদানির তেমন প্রয়োজনই পড়তো না বাংলাদেশের। মাত্র ছয় থেকে সাত লাখ টন ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে প্রায় প্রতি বছরই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সামপ্রতিক তথ্যটি হচ্ছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। ২০২১–২২ অর্থবছরে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। আর এবছর অর্থাৎ ২০২২–২৩ অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে ৩৪ লাখ টন পেঁয়াজ। গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১০ লাখ টন।
লক্ষণীয় হচ্ছে, দুই বছরে আগে যেখানে উৎপাদন হতো ২৫ লাখ টনের মতো, সেখানে এখন উৎপাদন হচ্ছে ৩৫ লাখ টনের মতো। বিপরীতে দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। দেখা যাচ্ছে দেশে পেঁয়াজ চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তো আমদানির প্রয়োজন না থাকার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায় । কারণ পেঁয়াজ সংরক্ষণের কোনও প্রযুক্তি বা কোল্ড স্টোরেজ দেশে নেই। পেঁয়াজ সংরক্ষণে যে সব মডেল ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলো সম্পন্ন হলে এই সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।এগুলো পরের কথা, আশার কথা। কিন্তু পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি প্রদানে সরকারের দীর্ঘসূত্রতা, দোদুল্যমানতায় সাধারণ মানুষের পকেট থেকে সিন্ডিকেটররা যে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিল তার বিচার করবে কে?
পেঁয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আদার দাম। দাম বাড়ার পেছনে যে অজুহাত দেখাচ্ছে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাতে কতটুকু সত্যতা আছে তা জানার উপায় যেহেতু সাধারণ মানুষের নেই সেহেতু আদা কিনতে গিয়ে জাহাজের খবর নিচ্ছে না কেউ।
হঠাৎ করে মাস দেড়েক–দুয়েক আগে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকার বয়লার মুরগির দাম যে প্রতিকেজিতে ১০০ টাকা বাড়লো তার কারণ কী জানে না ক্রেতারা। ডিমের ডজন কেন ১৫০ টাকা হলো তার ব্যাখ্যা কী? তা–ও জানে না ক্রেতারা। আন্তর্জাতিক বাজারে পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে এইসব মাফিয়ারা কত টাকা খসিয়ে নিচ্ছে তার হিসাবটা কে দেবে? কে নেবে?
আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকটি কেলেঙ্কারির নায়কদের চিনি। তারা আমাদের সমাজে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে বাস করে। আমরাও তাদের অত্যন্ত সমীহ করে চলি। ব্যাংকের টাকা তথা জনগণের টাকা মেরে কেনা কয়েক কোটি টাকা দামের গাড়ি দেখে দ্রুত পথ ছেড়ে দিই। রাষ্ট্র যেখানে দুষ্টের দমন করবে সেখানে রাষ্ট্রকেই থোড়াই কেয়ার করে দুষ্টরা।
এই দুষ্টচক্র চাক্তাই–খাতুনগঞ্জকে ছোবড়া বানিয়ে এখন পুরো দেশটিকেই ছোবড়া বানানোর তালে আছে। দেশ ছোবড়া হলে ওদের কোনো ক্ষতি নেই। কারণ আমাদের মতো সাধারণ মানুষরাই দেশকে ধারণ করে পড়ে আছি দেশে। আর ওরা অনেক আগেই এই দেশকে পরিত্যাগ করেছে। লেখক : কবি–সাংবাদিক