কাল আজকাল

বইমেলা নিয়ে আপত্তি এবং মেলার সমন্বয়হীনতা

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

আমার এক ছোটভাই ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করতে গিয়ে আমাকে ট্যাগ করেছেন। দুয়েকজন আমার ম্যাসেঞ্জারে একই স্ট্যাটাসটি পাঠিয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। মূল পোস্টদাতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে তাঁর পোস্টটি যেহেতু পাবলিক করা ছিল সেহেতু সে বিষয়ে মতামত প্রদান নীতি ও আইন বহির্গত হবে না বলে কিছু কথা বলব। বইমেলা শুরু হওয়ার পরদিন আলমগীর মো. সিরাজউদ্দীন সাহেব তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘খেলার মাঠে বই মেলা! কি অসাধারণ পরিকল্পনা! খেলার মাঠে কেন মেলা হবে? বই মেলা করার জন্য কি অন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিতে পারতেন না আয়োজকেরা? কোথায় খেলবে ছেলেমেয়েরা? কোথায় আছেন তথাকথিত মাঠ রক্ষার আন্দোলনকারীরা? ১২ দিনের মেলায় অন্তত ২ মাসের জন্য খেলার অনুপোযোগী হয়ে যাবে মাঠটি। প্রতিনিয়ত মেলার কারনে এমনিতেই মাঠটিতে একটা ঘাস ও আর অবশিষ্ট নেই। যারা ধূলোবালির মধ্যে ও অসুস্থ হওয়ার শংকা নিয়ে অনুশীলন করতে আসে তাদের অভিশাপ নিয়ে কেন এখানে মেলা করতে হবে? মেলা আয়োজনকারীদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। প্রসংগত উল্লেখ্য যে ঢাকা পল্টন ময়দানে খেলার মাঠের জায়গায় পার্কিং ভবন করার অনুমতি চেয়ে একটি ফাইল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে পৌছা মাত্রই তিনি খেলার জন্য উম্মুক্ত রেখে পল্টন ময়দানে গড়ে ওঠা সকল স্থাপনা (শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স সহ) দ্রুত উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন। চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়াম সহ সকল খেলার মাঠ মেলা মুক্ত রাখার জন্য মাননীয় ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বইমেলা আয়োজনের নেপথ্য ইতিহাসটি একটু বলি, গত শতকের আশির দশকের শেষ থেকে চট্টল ইয়থ কয়ারের উদ্যোগে মুসলিম হলের সামনে একুশমেলা শুরু হয়। জহির কাজী, অরুণ বণিকসহ কয়েকজন মিলে এই মেলার আয়োজন করতেন। দৈনিক পূর্বকোণের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক লেখকগবেষক নাসিরউদ্দিন চৌধুরী নেপথ্যে থেকে মেলা পরিচালনায় সহায়তা করতেন। পূর্বকোণে মেলা সংক্রান্ত সংবাদগুলো খুবই গুরুত্বের সঙ্গে ছাপাতেন। এই মেলা ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। ঢাকা থেকেও কিছু প্রকাশক মেলায় যোগ দিতেন। লেখকশিল্পীসাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের পদচারণা ও অংশগ্রণে মেলা একটি পূর্ণতার রূপ পেতে যাচ্ছিল।

১৯৯৯ সালের দিকের ঘটনা। তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী মেলার আয়োজকসহ চট্টগ্রামের লেখক, প্রকাশক, সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে এক মত বিনিময় সভায় প্রস্তাব করলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বইমেলার আয়োজন করবে আরও ব্যাপক পরিসরে। লালদীঘি মাঠ থেকে মেলা ও উৎসব শুরু হয়ে মিউনিসিপ্যাল স্কুল হয়ে শহিদ মিনার পর্যন্ত চলবে বইমেলা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উৎসব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রথম বছরেই প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয়। লালদীঘি মাঠে নামেমাত্র কয়েকটি স্টল বসলেও আর কোথাও কোনো উদ্যোগ বা কর্মসূচি পরিলক্ষিত হয়নি। প্রথম বছরই উদ্যোগটি ফ্লপ করে। মাঝখানে এই গ্যাড়াকলে পড়ে চট্টল ইয়থ কয়ারের একুশমেলার আয়োজনটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনে, ভিন্ন ভিন স্থানে, ভিন্ন ভিন্ন নামে বইমেলা করার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কোনোটিই যথার্থ ও সফল বইমেলা হয়ে উঠতে পারেনি। এরমধ্যে একুশে মেলা, স্বাধীনতার বইমেলা, মুক্তিযুদ্ধের বইমেলা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আয়োজিত একুশের বইমেলা ও চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি আয়োজিত বইমেলাসহ বেশকিছু আয়োজনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

কোনো একক ও সফল বইমেলা না হওয়া অনেকের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভও বিরাজ করছিল। এবং বড় পরিসরে একটি সমন্বিত বইমেলা করার দাবি সর্বমহলে আলোচিতও হচ্ছিল। আ জ ম নাছির উদ্দীন তখন সিটি মেয়র। অবশেষে সবার অনুরোধে তিনি সিটি করপোরেশন ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির সম্মিলিত উদ্যোগে লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীদের সমন্বয়ে বইমেলার আয়োজন করেন। তার জন্য স্থান নির্বাচন করেন জিমনেসিয়ামের সামনের খোলা চত্বরটি। ২০১৯ সাল থেকে এখানে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০২১ সালে কভিডের কারণে বইমেলা হয়নি।

তো আজ যারা এই বইমেলার আয়োজকদের বিরুদ্ধে খেলার মাঠ দখলের অভিযোগ এনে বইমেলার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছেন তাদের কাছে সবিনয়ে জানতে চাই তারাও কি চট্টগ্রামের খেলার মাঠ রক্ষায় কোনো অবদান রেখেছেন? এই জিমনেসিয়াম চত্বরে নানা সময়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়, মেলা হয় তখন কি এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন? আউটার স্টেডিয়ামে বছরের অধিকাংশ সময় গরু প্রদর্শনী থেকে শুরু করে কত অপ্রয়োজনীয় মেলা হয়, গভীর রাত পর্যন্ত মাইক বাজানো হয় তা নিয়ে কি প্রশ্ন তুলেছেন? আউটার স্টেডিয়াম যে ট্রাকস্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে তখন কি প্রতিবাদ করেছেন? পলোগ্রাউন্ড মাঠে মাসব্যাপী অন্তত দুটো পণ্যমেলা হয় তা নিয়ে কি কিছু বলেছেন? চট্টগ্রামের ফুসফুস বলে খ্যাত সিআরবি রক্ষা আন্দোলনের পক্ষে কি কখনো, কোথাও কোনো ভূমিকা রেখেছেন? ডিসিহিলে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হচ্ছে না বেশ কয়েকবছর ধরে তার বিরুদ্ধে কিছু বলেছেন? বলেননি। তাহলে কেন হঠাৎ বইমেলার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন? কেন এবং কাদের স্বার্থে নিচ্ছেন?

এবার মেলা নিয়ে বলি। মেলার একদিন আগে সাংবাদিক সম্মেলনে গিয়ে ধাক্কা খেলাম কর্তৃপক্ষের একটি সিদ্ধান্তের কথা শুনে। দেখলাম এবার মেলা চত্বরে ইট না বিছিয়ে তেরপাল বিছানো হচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মেয়র বললেন, খরচ বাঁচানোর স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায় ইট বিছাতে ২৫ লাখ টাকা খরচ হয়। আমরা যারা মেলায় যাই এবং মেলা সংশ্লিষ্টরা জানি ইট বিছাতে এত টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়। ইট ভাড়ায় আনা যায়। কিনে আনলেও মেলার পরে সে ইট আবার বিক্রি করা যায়। ইট বিছানো, অনুষ্ঠান শেষে সে ইট তোলা এবং ক্রয়মূল্যের চেয়ে সামান্য কম দামে বিক্রি করলে লাখ পাঁচেক টাকা খরচ হওয়ার কথা। এটা কাউকে চুক্তিতেও দেওয়া যেত। সিটি করপোরেশনের কোনো উন্নয়ন প্রকল্প থেকেও কিছু সময়ের জন্য ইট আনা যেত। এখন তেরপালের কারণে ধুলোর পরিমাণ বেড়েছে। বয়স্ক ও নারীশিশুরা তেরপালের ওপর স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারছে না। বৃষ্টি পড়লে তেরপালের ওপর হাঁটাও যাবে না। এই পরামর্শ কারা দিয়েছেন জানি না তবে তাতে সমালোচনার তীর বিদ্ধ করছে মেয়র মহোদয়কে।

প্রতিবারের মতো এবারও মঞ্চে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকলে তাতে সমন্বয়হীনতার চিত্র প্রকট। আগে থেকে অনুষ্ঠানসূচি চূড়ান্ত না করায় আজ নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কাল কী অনুষ্ঠান থাকবে এবং তাতে কোন কোন অতিথি থাকবেন। এ নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। উদাহরণস্বরূপ আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। মেলার দ্বিতীয় দিন প্রেসক্লাবের স্টল উদ্বোধনের সময় এবং পরবর্তীতে মেলার অফিসে মেলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালনকারী কাউন্সিলর বললেন, ১৪ তারিখ আপনি আলোচক হিসেবে থাকবেন। মাঝখানে দুদিন আমি মেলায় যাইনি। ১৪ তারিখ দুপুরে মেলা কর্মকর্তা আশেক রসুল টিপুকে ফোন করে জানতে চাইলাম, আজকের অনুষ্ঠান কি ঠিক আছে? তিনি জানালেন, সূচি পরিবর্তন হয়েছে। আপনি থাকবেন ২৪ তারিখ। সেদিন বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি থাকবেন। বললাম, এ সিদ্ধান্তটি আপনারা জানালেন না। আমি ফোন না করলে অনুষ্ঠান স্থলে গিয়ে আমাকে বিব্রত হতে হতো। তিনি আমার কথায় ক্ষুণ্ন হয়েছেন বুঝলাম কারণ, বক্ষমাণ লেখাটির জন্য একটি তথ্য জানতে পরবর্তীতে তাঁকে দুবার ফোন করার পরও তিনি ফোন ধরেননি এবং পরে কলব্যাক করেননি।

সিটি করপোরেশন এই মেলার আয়োজন করছে বটে তাই বলে সবকিছুতে সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টদের মাতব্বরি থাকতে হবে কেন? কবিতাপাঠের দিন সে অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কবির সঙ্গে এক কাউন্সিলর অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রতিবাদ করেছেন কেউ কেউ। এমন আচরণ ও প্রবণতা পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। মনে রাখতে হবে, এটি বইমেলা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সমাজের অগ্রসর চিন্তার মানুষজন। কাজেই পণ্যমেলা, বৃক্ষমেলা, জামদানীমেলা বা বস্ত্রমেলার সঙ্গে এই মেলার গুরুত্ব, ভাবগাম্ভীর্য, মর্যাদা ও পরিবেশ এক করে ফেলা উচিত হবে না। সিটি করপোরেশন এই মেলার আয়োজন করলেও সহযোগী ও অংশগ্রহণকারীরা আলুপটল বিক্রেতা নন। কাজেই মেলার স্বার্থে পরস্পরের প্রতি যথাযথ সম্মান বজায় রাখা দরকার। আর মেলা যেহেতু হবেই সেহেতু প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা কয়েকমাস আগে থেকে নিয়ে রাখলে মেলা চলাকালে বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতার ঘটনা ঘটবে না।

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বইমেলা নয় কেন!
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম