কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

গত শতকের মাঝামাঝিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিশ্বে শান্তি ও মুক্তির সুবাতাস দেখা দিয়েছিল। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর বিশ্বনেতারা শান্তির অভাব অনুধাবন করেছিলেন তাই গঠন করেছিলেন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ যা পরে জাতিসংঘ নামে পরিচিতি ও ব্যাপকতা লাভ করে।

 

শুরু থেকে কয়েকদশক বিশ্বে শান্তি স্থাপনে জাতিসংঘ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। শান্তি স্থাপন ছাড়াও সদস্য দেশগুলোতে মানবাধিকার রক্ষা, শিক্ষা বিস্তার ও সংস্কৃতি রক্ষায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানসমূহ।

গত শতকের পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তর দশককে মানুষের জন্য স্বর্ণালী সময় হিসেবে গণ্য করা হয়। (সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার কলঙ্কজনক ঘটনাটি ছাড়া) এই তিন দশকে বিশ্বের অনেক দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।

বিশ্বব্যাপী শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র বিকাশ লাভ করে। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর তরুণদের মধ্যে সমাজতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক শক্তির উন্মেষ ঘটে।

রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে থাকে সাম্যবাদী দলগুলো। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। শতকের শেষ দুই দশকে আবার পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। নব্বই দশকের শেষে এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে বিপর্যয় নেমে আসে বিশ্বরাজনীতিতে।

এই ভাঙনের কারণে পরাশক্তির নতুন মেরুকরণ ঘটে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের পথ সহজ হয়ে ওঠে। আগে ক্ষমতার ভারসাম্য ছাড়াও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একদিকে পুঁজিবাদী অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে স্বাধীন হতে থাকে যুক্তথাকা রাষ্ট্রগুলো। সে সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও সোভিয়েত বলয় থেকে বেরিয়ে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বদলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এসময় পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্লোগান গ্লোবালাইজেশনজনপ্রিয় হতে থাকে। এবং তাদের প্রেসক্রাইব করা মুক্তবাজারঅর্থনীতিকে গ্রহণ করে প্রায় দেশ।

এই ব্যবস্থার মধ্যে ইউরোপে কল্যাণ রাষ্ট্রবা ওয়েলফেয়ার স্টেটধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাদের পথ অনুসরণ করে বিশ্বের অনেক দেশ তাদের জনগণের অধিকার ও সুবিধা নিশ্চিত করতে ওয়েলফেয়ার স্টেটপ্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়। তাতে অবশ্য অবাধ পুঁজির বিকাশ নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠী মোট কথা করপোরেট হাউসগুলো রাতারাতি মিলিওনিয়ার থেকে বিলিওনিয়ারে পরিণত হতে থাকে।

পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ধনীদরিদ্রের ব্যবধান ঘোচানো তো পরের কথা কমিয়ে আনতেও ব্যর্থ হয়। এর ফলে সে দেশগুলোতে তো বটে বিশ্বব্যাপী ধনীদরিদ্রের ব্যবধান দিনদিন বাড়তে থাকে। বর্তমানে তা অকল্পনীয় স্তরে উপনীত হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক দাভোস সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল ‘সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বের ধনী ও অতিধনীদের সম্পদ বেড়েই চলেছে। ২০২০ সালের পর সারা বিশ্বে যত সম্পদ তৈরি হয়েছে, তার দুইতৃতীয়াংশ বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর ঘরে গেছে।

একই সময়ে বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের ঘরে গেছে অবশিষ্ট একতৃতীয়াংশ সম্পদ। এখানেই শেষ নয়, গত এক দশকে বিশ্বে যত সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে, তার অর্ধেকের মালিক হয়েছেন শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী।অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে তাদের গবেষণা প্রকাশ করে থাকে। মহামারির এমন এক সময়ে শীর্ষ ধনীদের সম্পদ বেড়েছে যখন বিশ্বে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে।

মহামারি ও রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে দেশে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশেও একই চিত্র পাওয়া যায়। অর্থাৎ নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার খানিকটা কম ছিল। তবে ২০২২ সালে রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি থমকে গেছে। বিগত আড়াই দশকের মধ্যে ৩ বছর ধরে অতিদরিদ্র ও অতিধনীর সংখ্যা একইভাবে বেড়েছে। হিসাবটি খুব সহজ; অতি ধনী বৃদ্ধি পাওয়ার বিপরীতে অতি দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

অক্সফামের সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০২০ সালের পর বিশ্বে ৪২ ট্রিলিয়ন বা ৪২ লাখ কোটি ডলারের সম্পদ তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে ৬৩ শতাংশ বা ২৬ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ পকেটে ভরেছে বিশ্বের ১ শতাংশ শীর্ষ ধনী।

বাকি ৩৭ শতাংশ বা ১৬ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ ভাগ হয়েছে দুনিয়ার বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে। বিশ্বে তৈরি হওয়া সম্পদ থেকে সমাজের নিচের দিকের ৯০ শতাংশ মানুষের ১ ডলার আয়ের বিপরীতে বিলিয়নিয়াদের আয় ১৭ লাখ ডলার।দেখা যাচ্ছে, মাত্র ১ শতাংশ ধনী বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সম্পদ গিলে ফেলেছে। এমন অবস্থা চললে ভবিষ্যতে বিশ্বের অর্থনীতির কী হাল হবে তা আন্দাজও করা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে শীর্ষ ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। গত বছর কভিডের সময়ে ৯৫টি খাদ্য ও জ্বালানি কোম্পানি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা করেছে। গত বছর তাদের সম্মিলিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০৬ বিলিয়ন বা ৩০ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার তারা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করেছে।

এ ছাড়া মহামারির সময়ে মানুষের প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোও কয়েক গুণ মুনাফা করেছে। ঘরে বসে অফিস করা, ভার্চ্যুয়াল বৈঠক ও ক্লাসের কল্যাণে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো রমরমা ব্যবসা করেছিল। ওয়ালমার্টের মালিক ওয়ালটন পরিবার গত বছর ৮৫০ কোটি ডলার মুনাফা করেছে । জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ভারতের গৌতম আদানির সম্পদ এক বছরেই বেড়েছে কয়েক গুণ।

যার পরিমাণ ৪২ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এমন তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।অক্সফামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্তত অর্ধেক করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অতি মুনাফার প্রবণতার কারণে হয়েছে। এসব দেশে যথাক্রমে ৫৪ শতাংশ, ৫৯ শতাংশ ও ৬০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে করপোরেটদের উচ্চ মুনাফার কারণে।

স্পেনের অন্যতম বৃহৎ ট্রেড ইউনিয়ন সিসিওও বলছে, বিদায়ী বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশটির মূল্যস্ফীতির ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে করপোরেটদের উচ্চ মুনাফার কারণে। এমন এক সময় তা হয়েছে, যখন বিশ্বের প্রায় ১৭০ কোটি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম; অর্থাৎ তাঁদের প্রকৃত মজুরি কমেছে। প্রায় ৮২ কোটি মানুষ পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছে এবং এই জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই হলো নারী ও মেয়েশিশু।

বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের অর্ধেকই তারা। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে সম্ভবত গত তিন বছরে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। কী আশ্চর্য! মানুষের ভয়ানক দুর্গতির মধ্যেও সম্পদশালীরা তাদের সম্পদ বৃদ্ধির নির্লজ্জ অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই সময়ে বাংলাদেশের অবস্থা কী? সত্যি বলতে কী বাংলাদেশের অবস্থাও তার চেয়ে কোনোদিন থেকেই ভালো নয়।

শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে দরিদ্রের সংখ্যা কমিয়ে আনার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়। সরকার তাতে সফলও হয়। মহামারি পরিস্থিতিও অনেকটা সামলে নিয়েছিল সরকার কিন্তু রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাহিসেবে দেখা দিয়েছে। গত প্রায় দেড় দশকে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ও সেসঙ্গে মাথাপিছু আয় বাড়লেও ধনীদরিদ্রের ব্যবধান কমেনি বরং তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

একই বাস্তবতায় দারিদ্র্যের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে এক শ্রেণির মানুষের হাতে এসেছে অঢেল টাকা তার বিপরীতে হতদরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে। সুইস ব্যাংকে টাকা জমানো ব্যক্তিদের তালিকায় বাংলাদেশের অনেকের নাম আছে বলে দাবি করেছে দেশিবিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। এখন দুবাইতে সম্পদ পাচারের বিষয়টিও প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে দেশের উচ্চ আদালতও সরকারি সংস্থার কাছে বিশদ তথ্য চেয়ে রুল জারি করেছে।

এমন সংবাদ বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনক। কারণ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল বৈষম্য দূর করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

তিনি এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন স্বাধীনতার বহু আগে। স্বাধীনতার পর তাঁর অর্থনৈতিক কর্মসূচির বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।তিনি শোষিতের গণতন্ত্রের কথা বলতেন। রাষ্ট্রে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন। কাজেই বাংলাদেশের বর্তমান যে চিত্র আমরা দেখছি তা কারো কাম্য নয়।

অতি ধনী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এই প্রবণতা থামাতে হবে। থামাতে হবে পুঁজি পাচারের অপচেষ্টাও। সবশেষে বলতে হয়, অবাধ পুঁজির সংস্কৃতি যে এমন দানবের জন্ম দেবে তা তো নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না।

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবদুল হাকিম (র:) মাইজভাণ্ডারীর জীবন ও কর্ম
পরবর্তী নিবন্ধআগ্রাবাদ নওজোয়ান ক্লাবের ক্রিকেট অনুশীলন শুরু