কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ

নব নির্বাচিত মেয়রের কাছে নগরবাসীর প্রত্যাশা
মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের প্রথম নির্বাচিত মেয়র। তাঁর সামনে সফল কোনো মেয়রের দৃষ্টান্ত না থাকলেও নিজের অদম্য সাহস, উদ্যোম, মনোবল, দেশপ্রেম আর নেতৃত্বের গুণে তিনিই হয়ে উঠেছেন এক সফল ও অনন্য মেয়রের প্রতিকৃতি। তাঁর সময়টিই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সুবর্ণকাল। একটি বিধ্বস্ত নগরীকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন। সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার, নগরীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন। ‘বাল্টিস্কুল’ বলে বিদ্রুপ করা সিটি করপোরেশনের স্কুলগুলোর শিক্ষার মান বৃদ্ধি করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করেছিলেন। স্বীকার না করে উপায় নেই সে ধারাবাহিকতা তাঁর উত্তরসূরীরা বজায় রাখতে পারেননি।
দায়িত্বগ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের সভায় নবনির্বাচিত মেয়র সে সত্য অনুধাবন করে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্যসেবার অতীতের সুনাম আবার ফিরিয়ে আনা হবে। নগরবাসীর জন্য সুলভে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে ঢেলে সাজানো হবে মেমন মাতৃসদন হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, অন্যান্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো। তিনি বলেন, প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময়কালে কর্পোরেশন সব ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতো। আমি চাই স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও সেরকম ভূমিকা রাখুক।
মেয়র বলেন, সবসময় নানা সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা থাকবে। এরমধ্যেও নাগরিক সুবিধা ও সেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে পরিকল্পিতভাবে সাজাতে হবে। সকল ধরনের সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি ক্রয় ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে আধুনিকায়ন করা হবে। যাতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও নগরীর চিকিৎসাসেবায় মডেল হয়ে থাকে বাংলাদেশের মধ্যে।
বর্তমানে চসিকে ১০০ শয্যার একটি মেমন মাতৃসদন হাসপাতাল, ১০০ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতাল, ৫০ শয্যার তিনটি মাতৃসদন হাসপাতাল, ৫৩টি দাতব্য চিকিৎসালয় ও নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৩৩৫টি ইপিআই টিকাদান কেন্দ্র, ১০টি হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় রয়েছে।
২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৫৯৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে চসিকের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ২৬ হাজার ৯৮৪ জন। স্বাস্থ্যসেবার বিপরীতে গত বছর চসিকের আয় হয়েছে চার কোটি ৪২ লাখ ৪৬ হাজার ১২০ টাকা। অবশ্য প্রতি বছর চসিককে ১৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয় স্বাস্থ্য বিভাগে।
সভায় প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মেয়রকে জানিয়েছেন, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী হচ্ছে না। এতে মনোবল হারাচ্ছেন তারা। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের একটি অর্গানোগ্রামে ১৫০টি পদ খালি থাকলেও পূরণ করা হচ্ছে না। এমনকি ১৯৮৮ সালের অর্গানোগ্রামেও খালি আছে ১৮ মেডিকেল অফিসারের পদ।
আজাদীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাতৃসদন হাসপাতালগুলোর মধ্যে বন্দরটিলা নগর মাতৃসদন হাসপাতাল, সিটি কর্পোরেশন মেমন মাতৃসদন হাসপাতাল এবং মোহরা ছাফা মোতালেব সিটি কর্পোরেশন নগর মাতৃসদন হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। বন্দরটিলা ও মোহরা হাসপাতাল দুটির লিফট নষ্ট। বন্দরটিলা মাতৃসদনে পঞ্চম তলায় দেয়া হয় প্রসূতিদের চিকিৎসাসেবা। লিফট নষ্ট থাকায় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দুর্বিষহ কষ্ট হচ্ছে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা প্রসূতিদের। ছাফা মোতালেবের জেনারেটরও নষ্ট। মেমন মাতৃসদনের বেশিরভাগ কেবিনের এসি নষ্ট। টাইলসও ওঠে গেছে। হাসপাতালটির টয়লেটগুলোও ব্যবহার অনুপোযোগী। প্রয়োজনীয় সার্জিক্যাল বা মেডিকেল যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে সেখানে।
এদিকে চসিকের আরবান স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভবন নির্মাণ করে এডিবি। তাদের শর্ত ছিল শুধুমাত্র সেখানে চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন এবং বিদ্যুৎ বিভাগেরও দখলে আছে কোনোটি।
২০২০ সালের নভেম্বর মাসে মেমন মাতৃসদন অবকাঠামোগত এবং ক্লিনিক্যাল যন্ত্রপাতি দিয়ে সহযোগিতা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পত্র দিয়েছিল চসিক। কিন্তু এতে সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়।
যে ৩৭টি প্রতিশ্রুতি দিয়ে এম রেজাউল করিম চৌধুরী নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন তা ছিল অত্যন্ত গতানুগতিক। সেখানে চমকিত হওয়া বা উদ্বেলিত হওয়ার মতো তেমন কিছু ছিল না। অনেকটা মুখস্থ বুলির মতো। ইশতেহারে তিনি নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন, যানজট নিরসন, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, নালা-খাল-নদী থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ মোট ৩৭টি প্রতিশ্রুতি দেন।
আমরা জানি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বর্তমানে প্রচণ্ড আর্থিক অনটনের মধ্যে আছে। অনেক সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রদানেও সংকট পোহাতে হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনন্য মানবিক ও মহৎ দুটি কাজ চিকিৎসা ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে আর্থিক সংকটের কারণে। এ বিষয়ে রেজাউলের ইশতেহারে কিছু উল্লেখ ছিল না। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয়ের উৎস সীমিত। কাজেই সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল সিটি করপোরেশনের ভবিষ্যত নিয়েও তার কোনো পরিকল্পনার আভাস পায়নি কেউ। তিনি নির্বাচিত হলে করপোরেশন পরিচালিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে কী করবেন সে ধারণাও তিনি নগরবাসীকে দিতে পারেননি। তবে দায়িত্বগ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ে মেয়রের উদ্যোগে আশাবাদী হতে পারেন নগরবাসী।
শুরুতে বলেছি, মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ছিল সুবর্ণকাল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক নির্মাণ ও মেরামত এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর পর দিনদিন সাফল্যের চিত্রটি ধুলিধূসরিত হয়েছে। নজরদারি ও মনোযোগ কমেছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। আর বহুল প্রশংসিত স্বাস্থ্যসেবার এখন মলিন-বিবর্ণ চেহারা। মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে সিটি করপোরেশনের আর্থিক সংকট আছে তেমন কথা শোনা না গেলেও মেয়র নাছিরের সময় সমস্যাটি প্রকট হয়ে ওঠে। তবে ওয়াকিবহাল মহল জানে মেয়র নাছির সিটি করপোরেশন পরিচালনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যথাযথ সহযোগিতা পাননি।
সিটি মেয়র বা নগরপিতার মতো বেশ ভারী ভারী অভিধা ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশে একজন মেয়রের কাজ খুব একটা নেই। নালা ও বর্জ্য পরিষ্কার, মশকনিধন ও সড়কবাতি জ্বালানো ছাড়া আর তেমন কাজের এখতিয়ার মেয়র বা সিটি করপোরেশনের নেই।
এই ব্যবস্থার পরিবর্তন বা মেয়রের কাজের সুবিধা বা সিটি করপোরেশনকে কার্যকর করতে ঢাকার সাবেক মেয়র, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ চালুর দাবি তুলেছিলেন। তাকে অনুসরণ করে মহিউদ্দিন চৌধুরীও তার সময়ে ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর মহিউদ্দিন চৌধুরী দাবি থেকে সরে আসেন। সে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠায় সংবিধানের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে আশরাফ সাহেব মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিবৃত্ত করেছিলেন।
বছর তিনেক আগে সিটি করপোরেশন ভবনে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছিরের সঙ্গে আলোচনার একটি পর্যায়ে বন্দর থেকে একটি সারচার্জ আদায়ে জনমত গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়েছিলেন আ জ ম নাছির। সে সময় তিনি সড়ক নির্মাণ ও মেরামতে বন্দর থেকে একটি পারসেন্টেজ আদায়ের দাবিও করেছিলেন। এরপর তিনি এই দাবিতে আর সোচ্চার হননি। পরে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে খোরশেদ আলম সুজন বন্দর, কাস্টম এবং স্টিলমিল মালিকদের কাছ থেকে অন্তত এক পারসেন্ট সারচার্জ আদায়ের দাবি উত্থাপন করেন। সুজনের এই দাবির প্রতি নগরবাসীর সমর্থন থাকলেও রেজাউল করিমের ইশতেহারে তার কোনো উল্লেখ নেই। অনেকে মনে করেন এই দাবি প্রতিষ্ঠা করা গেলে সিটি করপোরেশনের আর্থিক টানাপোড়েন অনেকটা কেটে যেত।
আ জ ম নাছির মেয়র থাকাকালীন চসিকের স্বাস্থ্যসেবার মান কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তাঁর অসহায়ত্বের চিত্র তুলে ধরে বলেছিলেন, স্বাস্থ্যবিভাগে চিকিৎসক সংকট দূর করতে নতুন চিকিৎসক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রচারের কয়েকদিনের মধ্যে তা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের চাপে। সে সময় সিটি করপোরেশনের স্থায়ী চিকিৎসক নিয়োগের এখতিয়ার নেই বলে মন্ত্রণালয় আপত্তি জানিয়েছিল। ফলে নাছিরও সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে পারেননি।
বর্তমানে শিক্ষা, চিকিৎসা, সড়ক উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নালা-খাল দখল ও দূষণ এবং মশার উৎপাত নিয়ে নগরবাসীর বিস্তর অসন্তোষ আছে। আছে খেলার মাঠ, খোলা উদ্যান, পার্ক, লেক বা জলাশয়, চিত্তবিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ না থাকার ক্ষোভ। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রয়েছে সরকার। সিটি করপোরেশনও রয়েছে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্বে।
কাজেই সঙ্গত কারণে নগরবাসী একজন ডাইনামিক মেয়রের প্রত্যাশা করেছিল। তাই মেয়র পদে রেজাউল করিমের মতো স্বল্প পরিচিত ও অনালোচিত একজনের নাম দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন। যাই হোক, কথায় বলে ‘চেয়ার মেক অ্যা ম্যান’। রেজাউল করিমের সামনে যেহেতু মহিউদ্দিন চৌধুরীর উদাহরণ আছে সেহেতু সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে মহিউদ্দিনের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগ্রাবাদ এক্সসেস রোড এবং কে – এল ব্লকের কিছু রোডে স্প্রিড ব্রেকার অতি জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম