কালো টাকা সাদা করার সুযোগ : অসফল একটি প্রয়াস

রেজাউল করিম স্বপন | বুধবার , ২৪ আগস্ট, ২০২২ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

কালো টাকা। প্রতিবছর বাজেট উপস্থাপনের সময় এলেইএটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। কেউ বলেন কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সঠিক, কেউ বলেন সঠিক নয়। প্রশ্ন হলো? টাকা কি কখনো কালো হয়? পৃথিবীর কোথাও কালো রঙের নোট নেই। আসলে কালো টাকা মানে অবৈধভাবে অর্জিত কিংবা অপ্রদর্শিত টাকা। অবৈধভাবে অর্জিত সব টাকাই কালো টাকা। আবার বৈধভাবে উপার্জিত অর্থ যেটা কর দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত নয় সেটাও কালো টাকা। কালো টাকার পাহাড় গড়ে তোলে কালো বাজারি, দুষ্কৃতকারী, কর ফাঁকিবাজ ও আন্ডার গ্রাউন্ডের লোকজন। সোনার বাজার, টাকার লেনদেনে হুন্ডির আশ্রয় ও করমুক্ত পরিবেশে ব্যবসা করার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে কালো টাকার পাহাড় গড়ে ওঠে। কালো টাকার লেনদেনের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের নানা রকমের চক্র আছে। অসৎ ব্যবসায়ী ঘুষখোর চোরাকারবারি ও মানব পাচারকারীরা এর সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে পেশাজীবীদের অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থও কালো টাকা। যেমন চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্রাকটিসে যে অর্থ উপার্জন করেন তা যদি আয়কর রিটার্নে না দেখান, তাহলে সেটি কালো টাকায় পরিণত হয়। বাংলাদেশে কালো টাকার একটি বড় অংশ হলো পাচার করা অর্থ। অনেকে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বা রফতানির ক্ষেত্রে কাগজপত্রে অনিয়ম করে দাম বেশি বা কম দেখিয়ে, দেয় করের পরিমাণ কমিয়ে আনেন। এর মাধ্যমে যে অর্থ সরানো হয় সেটিও কালো টাকা। আবার রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের জমি সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। এসব জমি বিক্রয়ে বাজারমূল্য বা সত্যিকার অর্থে যে দামে বিক্রয় হয় সরকার সে দাম অনুযায়ী রাজস্ব পায় না। এই প্রক্রিয়াতেও প্রতি বছর বিপুল টাকা কালো টাকায় পরিণত হয়।
তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিলো কালো টাকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল সরকার এক ঘোষণায় ১০০ টাকার নোট বাতিল করেছিলো। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন এ আর মল্লিক। ১৯৭৫-৭৬ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি ‘মুদ্রাস্ফীতির চাপ প্রশমিত করা ও অর্থনীতিতে কালো ও বাড়তি টাকার অশুভ প্রভাব দূর করার কথা বলেছিলেন’। পরবর্তীতে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের শিল্পনীতি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত সেই শিল্পনীতিতে অব্যবহৃত ও নিস্ক্রিয় তহবিল উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করলে কোন প্রশ্ন করা হবে না বলে জানানো হয়েছিলো। তবে সরাসরি কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা ছিলো ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জারি করা সামরিক আইনের ৬ নং আদেশে। সেখানে ২৫% কর দিয়ে কর অনারোপিত আয় সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়, সেই থেকে শুরু। শুরুতে কিছুটা রাখঢাক থাকলেও গত দুই দশকে তা দেওয়া হয়েছে অবাধে। যদিও অর্থনীতিবিদরা একে অনৈতিক বলে মনে করেন। তাঁরা বলেন এতে সৎ করদাতারা ক্ষুব্ধ, অনৈতিকতা ও বৈষম্যের শিকার হন। এদিকে সংবিধানের ২০(২) নম্বর অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না’।
এরপরেও বাস্তবতার নিরিখে গত ৫১ বছরে দেশে ২১ বারে প্রায় ৪০ বছরই কোনো না কোনো ভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর ৫০টিরও বেশি দেশ বিভিন্ন সময়ে কালো টাকা সাদা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ দেশ এই সুযোগ দিয়েছে অল্প কয়েকবার ও কম সময়ের জন্য। যেসব দেশ পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে মূলত তারাই বেশি সাফল্য পেয়েছে। তবে বিশ্বে পাচারকৃত অর্থ ফেরতের সাফল্য খুব কম।
কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করা নিয়ে আইএমএফের একটি ম্যানুয়াল আছে। ২০২২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এটি প্রকাশ করা হয়। বিশ্বব্যাপী এই উদ্যোগকে স্বেচ্ছায় ঘোষণা বা ভলান্টারি ডিসক্লোজার প্রোগ্রাম (ভিডিপি) বলা হয়। অনেকে এটাকে কর মওকুফ বা ট্যাক্স এমেনেস্টি বলেন। এর আওতায় দেশের মধ্যে থাকা অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে অনেক দেশ এর অধীনে দেশ থেকে পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়। কিন্তু আইএমএফ শুধু অপ্রদর্শিত অর্থের কথাই বলেছে। কারণ তারা অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড হতে আসা অর্থ সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিরোধী। ম্যানুয়েলে বলা হয়েছে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ বারবার দেওয়া যাবে না। নির্ধারিত সময় শেষ হলে, যারা সুযোগ নিবেন না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। সাদা করার সুযোগ দিতে হবে সীমিত সময়ের জন্য। যাতে সামনে আরো সুযোগ আসবে এই আশায় কালো টাকার মালিকেরা তাদের অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে না পারে। আইএমএফের ঐ প্রতিবেদনে ২০টি দেশের কালো টাকা সাদা করার কর্মসূচি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায় হল্যান্ড সর্বোচ্চ পাঁচবার এই সুবিধা দিয়েছে। অন্যরা দিয়েছে এক থেকে তিনবার। তবে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল দেশ ইন্দোনেশিয়া। এদিকে ইন্দোনেশিয়ায় প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইকোনমিক এন্ড ফিন্যান্সিয়াল ইস্যু ২০১৭’ সংখ্যায় এশিয়ার নয়টি দেশের অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, এশিয়ার নয়টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ১৮ বার। ভারত ১১ বার শ্রীলঙ্কা ১১ বার ফিলিপাইন ১০ বার ও ইন্দোনেশিয়া ৪ বার।
এনবিআরের হিসাবে দেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে ২১ বার। এতে এই সুযোগ গ্রহণ না করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি ছিল ২ বার ১৯৭৬ (সামরিক শাসনের সময়) ও ২০০৭ (সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক) খ্রিস্টাব্দে। দুইবার হুমকি দেওয়া হলেও ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে উল্লেখযোগ্য অর্থ সাদা হয়েছিল। তখন ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা সাদা করেছিলো। এতে সরকার রাজস্ব পেয়েছিলো ৬৮৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে ২০০৭-০৮এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বৈধ হয়েছিল ৯ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা এবং এতে সরকার রাজস্ব পায় ৯১১ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অর্থ বৈধ হয় কোভিড কালিন বছর ২০২০-২১ এ মোট ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট কালো টাকা সাদা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫২২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৪ হাজার ৬৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
অস্ট্রিয়ার অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডারের সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৭ বছরে কালো টাকার গড় হার মোট জিডিপির ৩৩.১%। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থ বছরে জিডিপির পরিমাণ ছিল স্থির মূল্যে ৩০ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। গড় কালো টাকা ৩৩.১% হলে টাকার অংকে তা ১০ লাখ ৫ হাজার ৯৯৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। যা বাংলাদেশের দেড় বছরের বাজেটের চেয়ে বেশি। অথচ সে তুলনায় সাদা হয়েছে অতি সামান্য টাকা। তবে কোনো সরকার কখনো সুযোগ না নেওয়া কালো টাকা মালিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং নতুন করে আবার সুযোগ দিয়েছে। ফলে সবচেয়ে বেশি সুযোগ দেওয়ার পরও কার্যত এটি একটি ব্যর্থ কর্মসূচি হিসাবে পর্যবসিত হয়েছে। সেজন্য ৫০ বছরে কালো টাকা সাদা হয়েছে যৎ সামান্য। তাই বলা যায়, ব্যাপক প্রস্তুতি ও পূর্বশর্ত ছাড়া বছরের পর বছর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয় বলেই বাংলাদেশে কালো টাকা খুব একটা সাদা হয় না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৬ ঘণ্টা মহাসড়ক অচল, সীমাহীন দুর্ভোগ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় দশ জনের করোনা শনাক্ত