কারাগারে শিশুর বিচরণের জন্য অনুকূল পরিবেশ চাই, দরকার মানবিক উদ্যোগ

| মঙ্গলবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

আজাদীতে প্রকাশিত একটি সংবাদ নাগরিকদের মনে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। কারাগারে শিশুরা বেড়ে উঠছে অত্যন্ত অবহেলায়। এই অমানবিক সংবাদটি হলো : ‘কারাগারে মায়ের সঙ্গে ৬৩ নির্দোষ শিশু’। প্রকাশিত হলো ১৭ এপ্রিল। এতে বলা হয়েছে, ‘মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আমেনা বেগম (ছদ্মনাম) চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন দুই বছরের বেশি সময় ধরে। সঙ্গে থাকছে তার চার বছর বয়সী শিশু সন্তানটিও। আমেনার নাম বন্দি তালিকায় থাকলেও সেখানে নেই ছোট্ট শিশুটির নাম। তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ নেই। দণ্ডিত মায়ের সাথে তাকেও কারাগারে থাকতে হচ্ছে।
শুধু আমেনা নন, আমেনার মতো কক্সবাজারের নাছরিন আকতার, মমতাজ বেগমও তাদের দুগ্ধপোষ্যশিশুকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম কারাগারে আছেন কয়েক বছর ধরে। আমেনা বেগম, নাছরিন আকতার ও মমতাজ বেগমের সন্তানের মতো চট্টগ্রাম কারাগারে মায়ের সঙ্গে থাকছে ৬৩ নির্দোষ শিশু। এদের মধ্যে ৩২ জন ছেলে শিশু, ৩১ জন মেয়ে শিশু। গেল সপ্তাহে আজাদীকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী, বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি রয়েছে মোট ৭০৫১ জন। এর মধ্যে নারী বন্দি ৩৩৩ জন।’
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা ৭০৫১ বন্দির মধ্যে বেশিরভাগই হাজতি। কয়েদী রয়েছে প্রায় ৭০০ জন। এর মধ্যে ৮৮ জন হচ্ছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এদের ১ জন মহিলা। এখানে উল্লেখ্য, হাইকোর্ট ইতোমধ্যে রুল জারি করেছেন কারাগারে কোনো শিশু থাকবে না। এরপরও বিনা অপরাধে অনেক শিশু মায়ের সঙ্গে কারাগারের অন্ধ কুঠুরিতে বেড়ে উঠছে। সংবাদে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি আইনজীবী আকতার কবির চৌধুরীর মতামত প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, মহিলা রাইটার, হাজতি ও কয়েদীদের মাঝে বেড়ে ওঠায় কারাগারে থাকা শিশুদের শিশুসুলভ আচরণগুলো লোপ পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। কারাগারের ওই পরিবেশ থেকে তাদের সুস্থ পরিবেশে বড় হওয়ার বিকল্প সুযোগ বের করতে হবে।
যে বয়সে একটি শিশু আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার কথা, সেই বয়সে ওদের মায়ের অপরাধের কারণে তাদের কারাগারে থাকতে হচ্ছে। ওদের খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ আর শৈশবের মানসিক বিকাশের জন্য কারাগারে নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। নেই কোনো ডে-কেয়ার সেন্টার। যদিও কারাগারের জেলার দেওয়ান তারিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, একজন শিশুর যা কিছু প্রয়োজন তার সবই রয়েছে কারাগারে। হাঁটতে পারে, পড়তে পারে, খেলতেও পারে। খেলাধুলার সরঞ্জাম রয়েছে। মায়েরাও পর্যাপ্ত সময় কাটাতে পারেন তাদের শিশুদের সাথে। তিনি জানান, দিবাযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুরা এ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। যেমন বই, আদর্শলিপি, খাতা, কলম, পেনসিল, স্লেট, চক, ছবি আঁকার বোর্ড, বল, রং পেন্সিল ও নানা রকম খেলনা হাতের কাছে পায় শিশুরা।
তবু সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কারাগারে থাকার কারণে এসব শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে বাধা আসে। তারা সামাজিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে। তাঁরা বলেন, কারাগারে একটি ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলে শিশুদের মানসিক বিকাশের পথ সুগম হতো। এসব শিশু থাকার জন্য দরকার কারাগারের কাছে শেল্টার হোম। মায়েরা শেল্টার হোমে এসে তাদের সন্তানের সঙ্গে দেখা করবে। এই বন্দিজীবন থেকে আমাদের শিশুরা কবে মুক্তি পাবে। এসব শিশুর সুস্থ জীবন, সুন্দর পরিবেশে কিভাবে এদের বড় করে তোলা যায় এটা নিয়ে ভাবনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, শিশুর আবাস কারাগার হতে পারে না। মায়ের অপরাধে অপরাধী হয়ে শিশুরা এভাবে কারাগারে বন্দি জীবন-যাপন করবে তা সুস্থ-সুন্দর সমাজ-পরিবেশে কারো কাম্য হতে পারে না।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসানের বক্তব্য সংবাদে যুক্ত করা আছে। তিনি বলেন, বিনা অপরাধে শিশুর কারাগারে থাকা শিশু অধিকারের লঙ্ঘন। তাদের পক্ষে কর্তৃপক্ষের গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, কারাগারে শিশুর বিচরণের জন্য অনুকূল পরিবেশ নেই। মানবিক বিকাশ একদমই ঘটছে না।
আসলে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য নিরাপত্তাবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন মায়ের সঙ্গে তার শিশুটি কারাগারে থাকলে সে বুঝে যায় তার মা নিরাপদহীনতায় রয়েছে। ধীরে ধীরে এটা তার মনের ভেতর গেঁথে যায়। পরবর্তীতে আচরণে প্রকাশ পায়। এর কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা ওই আচরণগুলো নিজেদের মধ্যে ধারণ করে বড় হচ্ছে। ফলে এসব নেতিবাচক দিকগুলো তাদের মনে বিস্তার লাভ করে। এই পরিবেশে শিশুর শারীরিক বিকাশ বৃদ্ধি পেলেও মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ আদৌ সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের মানবিক উদ্যোগ প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে