কাপ্তাই রাস্তার মাথায় কেন বারবার সংঘর্ষ

সিএনজি স্ট্যান্ড ঘিরে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য দখলে রাখতে চায় দুই পক্ষ, জিম্মি চালকরা

ঋত্বিক নয়ন | বৃহস্পতিবার , ৭ মার্চ, ২০২৪ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

একসময় তিনজন ছিলেন হরিহর আত্মা, দুটি গ্রুপে এখন তারাই হয়ে গেছেন শত্রু। এ তিনজন হলেন হোসেন এবং মুজিবসাগর। কাপ্তাই রাস্তার মাথায় সিএনজি স্ট্যান্ড ঘিরে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য দখলে রাখতে এ দুটি পক্ষ ক’দিন পরপরই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়; সাথে পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার বিষয়টি তো আছেই। এ দুটি পক্ষের হাতে জিম্মি সিএনজি টেক্সি ও অটোটেক্সি চালকরা। রুট ও লাইন নিয়ন্ত্রণের নামে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করছে তারা। সাধারণ চালকদের অভিযোগ, মাসে ৪০৫০ লাখ টাকা টোকেনের বিপরীতে চাঁদা আদায় করছে চক্রটি। এই চাঁদার ভাগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ট্রাফিক পুলিশ, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন ব্যক্তির পকেটে যাচ্ছে। আর এ কারণে পরিবহন চাঁদাবাজরা কাউকে পরোয়া করছে না।

তবে সিএমপির চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবীর আজাদীকে বলেন, কোনো চাঁদাবাজকে প্রশ্রয় দেয় না পুলিশ। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, আমার এলাকায় কোনো চাঁদাবাজি হবে না। সর্বশেষ কাপ্তাই রাস্তার মাথায় ঘটনার সময়ও আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এলাকাবাসীকে বলেছি, চাঁদাবাজদের প্রতিরোধ করবেন, পুলিশ আপনাদের পাশে থাকবে।

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে দশটার দিকে রাস্তার মাথা এলাকায় সিএনজি টেক্সি স্ট্যান্ড দখল নিয়ে হোসেন ও মুজিবসাগর গ্রুপের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে উভয় গ্রুপের দশপনের জন আহত হয়। সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকজন প্রকাশ্যে ফাঁকা গুলি করে বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। এসময় সড়কের দুই পাশের কয়েকটি দোকান ও গাড়িতেও হামলা চালায় তারা। কয়েকজন পথচারীকেও মারধর করার অভিযোগ পাওয়া যায়। জানা গেছে, মুজিবসাগরের দখলে থাকা সিএনজি টেক্সি লাইন দখলে নিতে এসেছিল হোসেন গ্রুপ। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে মুজিবসাগর গ্রুপ। এ ঘটনার রেশ ধরে তার লোকজন হামলা চালায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে বোয়ালখালী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী ও কাপ্তাই লিচু বাগান এলাকা পর্যন্ত সিএনজি টেক্সি চলাচল করে। এসব রুটে প্রায় সাত হাজার টেক্সি টোকেন নিয়ে চলাচল করে। কথিত শ্রমিক নেতাদের কাছ থেকে এসব টোকেন নিতে হয়। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী ও কাপ্তাই লিচু বাগান এলাকায় চলাচল করে অন্তত ৬ হাজার টেক্সি। আর বোয়ালখালী রুটে চলাচল করে হাজারখানেক টেক্সি। এসব টেক্সি থেকে মাসে এক হাজার টাকা করে টোকেন নিতে হয়। এছাড়াও প্রতিদিন সকাল ও বিকেল লাইনম্যানের নামে ১০ টাকা করে ২০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। দিনে চার রুটের প্রায় চার হাজার টেক্সি চলাচল করে। সেই হিসেবে দিনে ৮০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। মাসে দাঁড়ায় ২৪ লাখ টাকা। সবমিলে মাসে ৫০৬০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি চলে কাপ্তাই রাস্তার মাথায়।

কাপ্তাই রাস্তার মাথায় সিএনজি স্ট্যান্ডকে কেন্দ্র করে টোকেন বাণিজ্যের অধিপতি ছিলেন মো. হোসেন। ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর অস্ত্রগুলিসহ তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। হোসেন গ্রেপ্তার হওয়ার পর বদলে যায় চাঁদাবাজির ক্ষেত্রও। চাঁদাবাজির রাজত্ব রাতারাতি দখলে নেয় হোসেনের শিষ্য মুজিব ও সাগর। হোসেন ফিরে এসে পুরনো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ থেকেই শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এ প্রসঙ্গে অটোরিক্সা অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মো. সাগর আজাদীকে বলেন, একসময় আমরা তিনজনই একই সংগঠনে ছিলাম। কিন্তু এ এলাকায় চলতে থাকা জুয়া, মাদক ব্যবসা চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় হোসেন আমাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে হয়রানি করতে থাকে। বাধ্য হয়ে আমরা তাকে ত্যাগ করে সাধারণ চালকদের কল্যাণে আলাদাভাবে সংগঠন পরিচালনা করতে থাকি। সে জেল থেকে বের হয়ে পুনরায় তার অপকর্ম চালাতে আমাদের উপর হামলা করছে। টাইগার পাস থেকে তার ভাইপোর নেতৃত্বে একদল মহিলা নিয়ে এসে সোমবার রাতে আমাদের ওপর মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়েছে। গুলি করেছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে। তবে চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য যে বর্তমানে তিনি ও মুজিবের দখলেএ বিষয়টি অস্বীকার করে সাগর বলেন, আমরা চাঁদাবাজি করি না। টেক্সি থেকে কোনো টাকাও নেয়া হয় না। টোকেন বাণিজ্যও নেই। অবশ্য একই অভিযোগ করে হোসেন পক্ষের লোকজনও।

এদিকে সরেজমিনে দেখা যায়, কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় সড়কে শৃক্সখলা রক্ষার নামে লাঠি হাতে তৎপর আছে ৮ থেকে ১০ যুবক। তাদের কেউ খালি সিএনজি বডি ও হুডে লাঠি চালিয়ে স্থান ত্যাগে বাধ্য করাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে শিশু নিয়ে থাকা নারী যাত্রীরাও আহত হয় বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুলিশের উপস্থিতির কারণে যুবকরা বেশ সতর্ক। কিছু দূর গিয়ে ওয়াপদা অফিসের সামনে তোলা হচ্ছে চাঁদা।

সরেজমিন পরিদর্শনে জানা যায়, চাঁদাবাজদের কেউ কেউ যানজট এলাকার কিছু ফাঁকা জায়গায় যাত্রী নিয়ে যাওয়া সিএনজি পথ রোধ করে ১০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে ছাড়ছে। চাঁদাবাজ চক্রটি হাতে জিম্মি হওয়া থাকা চালক ও যাত্রী সবাই বলেছেন কাপ্তাই সড়কে গণপরিবহন (বাস) সংখ্যা কম। এই কারণে শহরমুখী মানুষ নির্ভরশীল সিএনজি টেক্সির ওপর।

এসব স্থানে লাঠি নিয়ে সিএনজি নিয়ন্ত্রণের নামে সন্ত্রাসী কায়দায় চাঁদা আদায় করায় আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যরা কয়েকবার অভিযান চালিয়ে চাঁদা আদায়কারীদের গ্রেপ্তার করে কোর্টে চালান করা হলেও বন্ধ হয়নি চাঁদা আদায়। গত ফেব্রুয়ারিতে চাঁদাবাজির অভিযোগে নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাব৭ এর সহকারী পরিচালক নুরুল আবছার জানান, কাপ্তাই রাস্তার মাথায় সিএনজি টেক্সি থেকে চাঁদা আদায়ের সময় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপরও চলছে চাঁদাবাজি আর ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাজারে কারসাজি হলে ব্যবস্থা নিতে র‌্যাবকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধশ্রীপুর দরবারে বার্ষিক ফাতেহা কাল