কাজের ব্যাপ্তি ও গভীরতা বুঝেই বড় পরিকল্পনা নিতে হবে

| শুক্রবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালের এই দিনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের করা শিক্ষানীতির প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে মারা যান কয়েকজন ছাত্র। এরপর থেকে এই দিনটিকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিভিন্ন শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হওয়ার পর এটি বাস্তবায়নও শুরু হয়। কিন্তু নীতিতে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করাসহ জাতীয় শিক্ষানীতির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এক দশকেও বাস্তবায়ন হয়নি বলে শিক্ষাবিদরা উষ্মা প্রকাশ করেছেন নানা সময়ে। তবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে গত সোমবার জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপনের পর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, আগামী ২০২৫ সাল থেকে পুরোপুরি নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হচ্ছে। এতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষা দিতে হবে না। আর নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক কিংবা বাণিজ্যের মতো বিভাগ থাকবে না। ২০২৩ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা থাকবে না।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে অতি দরিদ্র পরিবারের ৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। ‘অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি ইন এডুকেশন : মিটিং আওয়ার কমিটমেন্টস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ইউনেস্কো বলছে, বাংলাদেশে অতি দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের ৫৭ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করলেও মাধ্যমিকে এসে তা ধরে রাখতে পারছে না। এসব পরিবারের ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগে ঝরে পড়ছে। মেয়েদের মধ্যে এ হার আরো বেশি। অতি দরিদ্র পরিবারের ৬৮ শতাংশ প্রাথমিক পেরোতে পারলেও মাধ্যমিক শেষ করার আগেই ঝরে পড়ছে এদের ৯৭ শতাংশ। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি এসব তথ্য সংযোজিত এ খবরটি প্রকাশিত হয়।
শিক্ষাবিদদের মতে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো সন্তানদের (ছাত্রদের) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি। মাধ্যমিকের সূচনা-শ্রেণিটি নির্দিষ্ট নয়, বিদ্যালয়ভেদে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম আর ক্যাডেট কলেজ শুরু হয় সপ্তম শ্রেণি থেকে। সন্তানদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করতে অনেক অভিভাবক তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি থেকে কোচিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিদ্যালয়কে উপেক্ষা করে কোচিংকেই গুরুত্ব দেন। ভর্তি পরীক্ষা যেহেতু বাংলা-ইংরেজি-গণিতের ভিত্তিতে হয়, তাই এ সময় শিক্ষার্থীরা মা-বাবার ইচ্ছায় অন্য বিষয় পড়ে না। কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্ট দিতে দিতে তারা পরীক্ষায় পাকা হয়ে ওঠে। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা তার পরবর্তী ধাপের ব্যবস্থা বা অব্যবস্থার দায় নিতে বাধ্য হচ্ছে। বইয়ের বোঝা বেড়েছে, এ কথা সত্য। এর একটি বড় কারণ পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এতে একদিকে যেমন বই ও পড়ার চাপ বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বয়সের চেয়ে উচ্চতর বিষয় মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষককে চমকে দিয়ে বেশি নম্বর আদায়ের কৌশল। প্রাথমিকে বই বেশি প্রয়োজন হয় না, যদি শিক্ষক পাঠদানে একটু সৃজনশীল হন আর ছাত্রদের জন্য নিজেরাই ওয়ার্কশিট বা অনুশীলনপত্র তৈরি করে নেন।
তাঁরা বলেন, পরীক্ষাকেন্দ্রিক মুখস্থনির্ভর শিক্ষার চাপে শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী পঠনপাঠন কমই হয়। একবার পড়তে শিখলে তার তো সে বিদ্যা প্রয়োগ করার ইচ্ছা হবে প্রবল। সে জন্য বিচিত্র স্বাদের বইয়ের সরবরাহ দরকার, প্রয়োজন শ্রেণিকক্ষে দলে মিলে আনন্দদায়ক সৃজনশীল সাহিত্য পাঠ ও শোনার ব্যবস্থা, আবৃত্তি শোনা-শেখা ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের আয়োজনই-বা কোথায়। আমাদের সব স্তরের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য পড়ার চাপে থাকে, অথচ গোটা শিক্ষাজীবনে তাদের মনোজগৎকে সমৃদ্ধ করার মতো পাঠের অবকাশ মেলে না। অবশ্যই এ পদ্ধতির অবসান হওয়া দরকার। তাঁরা আরো বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নের যে দায় এসডিজিতে রয়েছে, তারই অ্যাজেন্ডা হিসেবে এ কাজটাকে গণ্য করা উচিত। তা ছাড়া যেহেতু দেশে শিক্ষার সব স্তরেই মানের সংকট রয়েছে, তাই এ কাজের ব্যাপ্তি ও গভীরতা বুঝেই বড় পরিকল্পনা নিতে হবে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দও বাড়াতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে