কাজী নজরুল ইসলাম : প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি

| মঙ্গলবার , ২৫ মে, ২০২১ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলা সাহিত্যের আকাশে তাঁর আবির্ভাব ঝড়ের মতো। বাঙালির জীবনে তিনি জাগিয়েছেন নতুনের স্বপ্ন, তুলেছেন নতুন জীবনতরঙ্গ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অনন্যসাধারণ। নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৫শে মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে অপরিসীম দারিদ্র্যে। মাত্র দশ বছর বয়সে গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন-প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর প্রথমে বর্ধমান জেলার একটি হাইস্কুলে, পরে ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকেই ‘লেটো’ দলে যোগ দেন এবং পদ্য, গীত ও পালা গান রচনা আর সুরারোপে তাঁর অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় মেলে। নজরুল হয়ে ওঠেন সকলের প্রিয় কবিয়াল-গাইয়ে। ১৯১৭ সালে তিনি সৈনিক হিসেবে ৪৯ নম্বর পল্টনে যোগ দেন। এর আগে শিয়াড়শোল রাজস্কুল থেকে প্রবেশিকা নির্বাচনী পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এ পর্যন্তই ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। ১৯২০ সালে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হলে সাহিত্য জগতে এক শক্তিমান কবি হিসেবে আবির্ভুত হন নজরুল। তাঁর সাহিত্য জীবনের পরিধি মূলত তেইশ বছর। এর প্রথম দশ বছর প্রধানত কবিতা এবং শেষ তেরো বছর মুখ্যত সংগীত রচনা করেছেন তিনি। কিছু উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করলেও কবিতা আর গানেই তাঁর বিচিত্রমুখী প্রতিভার উজ্জ্বল স্ফূরণ ঘটেছিল। নজরুলের রচনায় রয়েছে বিশ্বসৃষ্টির প্রতি এক অপূর্ব সাম্য, দেশপ্রেম, উৎপীড়িত মানব মনের ব্যথা, মানবিক প্রেম, বিরহ, অসামপ্রদায়িক চেতনা – সর্বোপরী সকল অন্যায় আর গ্লানির বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠ প্রতিবাদ। এর জন্য নজরুলকে কারাভোগও করতে হয়েছে। নজরুলের গান বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিকামী জনতার প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। তারুণ্যের উন্মাদনায় জড়াগ্রস্ত পুরোনো সমাজ সংস্কার ভেঙে অফুরন্ত প্রাণশক্তি দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা করেছেন তিনি। তাঁর অসংখ্য গান ও কবিতায় শিশু মনের চেতনা এবং কোমল, মৃদু ব্যক্তিত্বেরও প্রকাশ পাওয়া যায়। কিন্তু ‘বিদ্র্রোহী কবি’ হিসেবেই তিনি খ্যাতিমান। নজরুলের বিপুল ও বৈচিত্র্যময় রচনার মধ্যে উপন্যাস: ‘বাঁধনহারা’, ‘কুহেলিকা’, ‘জয়যাত্রা’; ছোটগল্প ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’; কাব্যগ্রন্থ: ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘ভাঙার গান’, ‘নতুন চাঁদ’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘ছায়ানট’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নজরুল পরপর তিনটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এগুলো হলো: দৈনিক নবযুগ, সাপ্তাহিক ধুমকেতু, এবং সাপ্তাহিক লাঙল। ১৯৪১ সালে পিক্‌স ডিজিজ নামে এক রোগে মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায় নজরুলের। ভিয়েনায় কয়েক মাস চিকিৎসা শেষে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়। মস্তিষ্ক বিকল কবি এভাবেই বেঁচে থাকেন পঁয়ত্রিশ বছর। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে কবিকে নিয়ে আসা হয়, দেওয়া হয় নাগরিকত্ব। তাঁর চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কবি আর সুস্থ হন নি। অবশেষে চির অশান্ত, বিদ্রোহী কবি ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে প্রয়াত হন। নজরুল রচিত ‘বিদ্রোহী’ বাংলা সাহিত্যে বিপুল প্রভাববিস্তারকারী একটি কবিতা। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এক বৈঠকে বসে তিনি যুগান্তকারী এই কবিতাটি লেখেন। এ বছর বাংলা কাঁপানো কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনার শতবর্ষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএই দিনে
পরবর্তী নিবন্ধআমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সোনার বাংলা স্বনির্ভর হচ্ছে না