কাজী জাহাঙ্গীরের গল্প : চলমান জীবনের চিত্র

বিচিত্রা সেন | বুধবার , ২০ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

কাজী জাহাঙ্গীরের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আমিও কি তবে ভালোবাসি তারে’। আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ছোট ছোট ঘটনা গল্পগুলোর উপজীব্য। গল্পগ্রন্থটির প্রথম গল্পের নামেই গ্রন্থটির নামকরণ।

প্রথম গল্পটিতে আমরা দেখি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এক তরুণের বয়ানে গল্পটি এগিয়ে চলেছে। এক নারীকে ঘিরে দুই তরুণের সংকট। ওরা তিনজনই চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী। তিতাসকে ভালোবাসে দুই বন্ধু। কিন্তু কেউ তা স্পষ্ট করে বুঝতে পারে না। অবশেষে তিতাসের এক জন্মদিনে গল্পের নায়ক তিতাসের বাসায় উপস্থিত হয় ফুল নিয়ে, কিন্তু বিদায় নেবার আগে সে দেখতে পায় তার বন্ধু মিজুও চলে এসেছে,তবে তার হাতের ফুলের বাকেটটি অনেক বড়। নিজের দীনতায় কুণ্ঠিত নায়ক তিতাসের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বুকে জ্বলতে থাকে তীব্র আগুন। ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে একসময় তার মনে হয় তবে কি সে তিতাসকে ভালোবাসে? নাহলে মিজুর সাথে তিতাসের ঘনিষ্টতা দেখে তার বুকে এত জ্বলছে কেন? এখানেই গল্পটি শেষ। লেখক এখানে মানবমনের চিরন্তন ঈর্ষাকে চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছেন।

নারীর শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা এবং তা বাস্তবায়নে নানামুখী বাধার চিত্র ফুটে উঠেছে ‘ভাঙাচোরা স্বপ্ন’ গল্পে। শারমিন নামের এক কিশোরী চায় লেখাপড়া শিখে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে। কিন্তু বাধ সাধে তার মা। টানাটানির সংসারে শারমিনের লেখাপড়া করাটা বাড়তি খরচ। তাই মেয়েমানুষের বেশি লেখাপড়া করতে হবে না বলে মায়ের যুক্তি। শারমিনের খালাতো ভাই এ কথার প্রতিবাদ করলে তাকে চরমভাবে অপমানিত হতে হয়। তবুও হাল ছাড়তে চায় না শারমিন। শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস শারমিনের সমস্ত স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দেয়।সর্বস্বান্ত হয়ে যায় শারমিনদের পরিবার। লেখাপড়া নিয়ে অতল গহ্বরে পড়ে শারমিন। কী হবে তার ভবিষ্যৎ সে প্রশ্ন রেখে গল্পকার গল্পটি শেষ করেছেন।

একটু ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে আরেকটি গল্প ‘ইস স স স স’। গল্পটি আবর্তিত হয়েছে তিতাস চৌধুরী নামের এক শিক্ষিকাকে নিয়ে। তিনি একটি স্কুলের শিক্ষিকা। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় শিক্ষিকাদের জন্য মিউজিক্যাল চেয়ার নামে একটি ইভেন্ট রাখা হয়েছে। এগারোটি চেয়ারকে কেন্দ্র করে গানের তালে তালে বারোজন শিক্ষিকা ঘুরতে থাকেন। এভাবে একজন করে শিক্ষিকা আউট হতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত চেয়ার থাকে একটি,শিক্ষিকা দুজন। তিতাস চৌধুরী এবং শাহিদা ম্যাডাম। তীব্র উত্তেজনা মাঠ জুড়ে। দর্শকরা দুভাগে বিভক্ত। একদিকে গভর্নিং বডির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক,অন্যদিকে বাকি শিক্ষকরা। শেষ পর্যন্ত তিতাসকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে শাহিদা ম্যাডাম চেয়ারে বসে পড়ে। চারদিক থেকে ধ্বনি ওঠে ইস স স স স! সকল শিক্ষকের মতকে অগ্রাহ্য করে সভাপতি শাহিদা ম্যাডামকে বিজয়ী ঘোষণা করে। লজ্জায়, অপমানে মাঠ ছাড়ে তিতাস ম্যাডাম। পাঠক হৃদয়ে আফসোস ছড়িয়ে গল্পটি এখানেই শেষ হয়।

‘ভালোবাসে, ভালোবাসে না’ এক তরুণের হৃদয়ের তীব্র আকুলতার গল্প। সোহেল সদ্য মাস্টার্স পাশ করা কর্মজীবী এক তরুণ। ব্যাচমেট তিতাসকে তার খুব পছন্দ,কিন্তু সে কথা মুখে প্রকাশ করতে পারে না। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েই সে একটা চাকুরিতে জয়েন করেছে। মনে মনে স্বপ্ন দেখে তিতাসকে কাছে পাবার। একদিন সত্যি সত্যি তিতাস এসে উপস্থিত হয় তার ঘরে। কিন্তু তাকে দেখে প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে পড়ে সোহেল নামের তরুণটি। তার এই নার্ভাসনেস দেখে তিতাস তাকে সহজ করার জন্য চলে যাবার উদ্যোগ নেয়। সোহেল তবুও তিতাসকে কিছু বলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তিতাস চলেই যায়। হতাশায় ভেঙে পড়ে সোহেল ভালোবাসার কথা বলতে না পারার ব্যর্থতায়। শেষ পর্যন্ত মনের যুদ্ধ থামাতে সে এক অভিনব পথ খুঁজে নেয়। আগের দিন নিজের জন্মদিন উপলক্ষে কেনা একটা গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে সে ফেলতে থাকে নিচে, আর বলতে থাকে, ‘ভালোবাসে, ভালোবাসে না’। তার প্রতীক্ষা, শেষ পাপড়িটি তাকে কী জানান দেয়। তিতাস কি তাকে সত্যিই ভালোবাসে? নাকি ভালোবাসে না?

এভাবে প্রায় প্রতিটি গল্পেই কাজী জাহাঙ্গীর জীবনে চলার পথের নানা ছোট ছোট নাটকীয় মুহূর্তকে তুলে ধরেছেন। কখনো বা তিনি তুলে এনেছেন অব্যক্ত ভালোবাসার কথা। কখনো বা এনেছেন অর্থের কাছে ভালোবাসার পরাজয় মানার কথা। কখনো বা তুলে ধরেছেন মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার কথা। কখনো বা কোনো এক প্রতিবন্ধী নারীর বিজয়গাথা। গল্পগ্রন্থটিতে মোট বারোটি গল্প আছে। গল্পগুলো হলো–আমিও কি তবে ভালোবাসি তারে, ভাঙাচোরা স্বপ্ন,ইস স স স স,ভালোবাসে ভালোবাসে না,ঠিকানা জানা নেই, হায় আমার সুন্দরী বউটা, ফড়িং চোখের দৃষ্টি, বৈশাক ডা কী শাক, ভেঙে গেলো ভুল,প্রমোশন, দ্বিধা, অন্তরের ক্ষরণে শ্রাবণ।

কাজী জাহাঙ্গীরের গল্পগুলোতে বিষয়বৈচিত্র্য আছে,আছে সমাজের নানাশ্রেণির চরিত্র। তবে গল্পের গাঁথুনির ব্যাপারে লেখককে আরও সচেতন হতে হবে। ছোটগল্পের যেটা প্রাণ, শুরু আর শেষে চমক,সেইদিকে লেখককে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা আশা রাখি লেখকের পরবর্তী গল্পগ্রন্থে আমরা সেই অপূর্ণতা পুষিয়ে নেবো। চলমান জীবনের গল্পগাথা ‘আমিও কি তবে ভালোবাসি তারে’ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে শৈলী প্রকাশন। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন উত্তম সেন। এটি
পাঠকের কাছে সমাদৃত হোক এই কামনা রইলো।

লেখক : কথাসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুখের উচ্ছ্বাস
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে