কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে রেল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ জরুরি

| মঙ্গলবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, রেল দুর্ঘটনার ৮০ শতাংশের বেশি ঘটছে কর্মীদের ভুলে কিংবা অবহেলায়। নগরীর খুলশী থানাধীন ঝাউতলা-জাকির হোসেন রোড রেল ক্রসিংয়ে ডেমু ট্রেনের সাথে বাস, ম্যাক্সিমা ও সিএনজি টেক্সির সংঘর্ষে একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, একজন ট্রাফিক কনস্টেবলসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ১০ জন। গত শনিবার বেলা পৌনে ১১টায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেন আসার এই সময়ে গেটম্যান আশরাফুল আলমগীর ভূইয়া ক্রসিংয়ের পশ্চিম পাশের ব্যারিয়ার ফেললেও পূর্ব পাশের ব্যারিয়ার না ফেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ, রেলওয়ে কর্মকর্তা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন। এভাবে একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনায় রেল ব্যবস্থাপনা দিন দিন ভেঙে পড়ছে কি না, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার দুটি কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, মানবিক ভুল (হিউম্যান এরর); দ্বিতীয়ত, কারিগরি ত্রুটি। গড়ে ৮০ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মানুষের ভুল। অর্থাৎ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভুলে বা অবহেলায় দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষের ভুলের মধ্যে রয়েছে লাইন পরিবর্তনের জোড়া (পয়েন্টস) ভুলভাবে স্থাপন করা ও ভুল সংকেত দেওয়া। এ কাজগুলো সাধারণত স্টেশনমাস্টার ও তাঁর অধীন ব্যক্তিদের কাজ। সংকেত ও যথাযথ গতিনির্দেশিকা না মেনে ট্রেন চালান চালক ও সহকারী চালকেরা। অন্যদিকে কারিগরি ত্রুটির মধ্যে লাইনের ত্রুটি, ইঞ্জিন-কোচের ত্রুটি বড়।
রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে সূত্র বলছে, মানুষের ভুল এড়ানো সম্ভব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কড়া শাস্তি দিয়েও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়। কিন্তু রেলে মানুষের করা ভুল শোধরানোর জন্য তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। আর শাস্তি কেবল নিচের দিকের কর্মীদের হয়। তদন্তে বড় কর্মকর্তাদের নাম আসে না, শাস্তিও হয় না। তবে কারিগরি ত্রুটি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও লোকবল আছে। গত ১১ বছরে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজারের বেশি।
গত ৫ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, চট্টগ্রামে রেল ক্রসিংগুলোর অর্ধেকের বেশি অবৈধ, কোথাও লোক থাকে না, কোথাও দায়িত্বে অবহেলা, নেই তদারকি। এতে আরো বলা হয়, রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। দীর্ঘ এই পথে মোট লেভেল ক্রসিং রয়েছে দুই হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৪০০টি বৈধ লেভেল ক্রসিং থাকলেও বাকিগুলো অবৈধ। দেশে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মোট অবৈধ রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ১৪১টি। ১ হাজার ৪শটি বৈধ রেল ক্রসিং থাকলেও গেটম্যান রয়েছে মাত্র ৪৬৬টিতে। বাকিগুলো ‘ঠিকা’ লোকবল দিয়ে চালানো হয়। আবার অবৈধ রেলক্রসিংগুলোতে কোনো লোকবল নেই। এসব ক্রসিং একেকটি মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে মোট ১ হাজার ২৩০টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে বৈধ রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৫১১টি। বাকিগুলো অবৈধ। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেল ক্রসিং রয়েছে ২০৫টি। এর মধ্যে ১১০টি বৈধ। চট্টগ্রামে মোট ৯৫টি অবৈধ ক্রসিং রয়েছে। পূর্বাঞ্চলের ৫১১টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে গেট ব্যারিয়ার আছে ২৫৭টির। এর মধ্যে ২২৯টি গেটে গেটম্যান থাকলেও বাকিগুলোতে কোনো গেটম্যান থাকে না। অবৈধ ক্রসিংগুলোতেও কোনো গেটম্যান নেই। এতে করে বৈধ-অবৈধ মিলে গেটম্যান নেই এমন ক্রসিংয়ের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক। চট্টগ্রামের ৯শটির বেশি ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই, নেই ব্যারিয়ার।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, রেলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কারিগরি নিরাপত্তার বিধান করা আছে। এটা নির্ভর করে রেলের কর্মীদের ওপর। কর্মীরা সেই কাজটিই ঠিকভাবে করছেন না। যেমন, রেলের ইঞ্জিনে এমন কারিগরি ব্যবস্থা আছে যে, চালক ও সহকারী চালক অলস বসে থাকলে ট্রেন চলবেই না। চালক বা সহকারী চালক যদি একটানা ৫০ সেকেন্ড স্পিড বাড়ানো, কমানো, ব্রেক করা, হর্ন দেওয়ার কাজ না করেন, তাহলে এক মিনিটের মধ্যে ট্রেন থেমে যাবে। এর বাইরে ‘ডেডম্যান প্যাডেল’ বলে একটা ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ ব্রেক কিংবা গতি বাড়ানোসহ চালকের যদি কিছুই না করার থাকে, তাহলে চালককে একটি নির্দিষ্ট বাটন চাপতে হয়। মূলত চালকেরা ঘুমিয়ে গিয়ে যাতে দুর্ঘটনায় না পড়েন, সে জন্যেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু রেলের প্রায় সব ইঞ্জিনেই এই ব্যবস্থা বিকল করা আছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেন, একের পর এক ভুল হতে থাকলেও কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে রেলের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। রেলে অব্যবস্থাপনার দুটি কারণ চোখে পড়েছে। রেলের জনবলের ওপরের দিকের অর্থাৎ বড় কর্তাদের একটা বড় অংশের মনোযোগ এখন উন্নয়ন প্রকল্পে। কারণ, সেখানে প্রচুর পয়সা আছে। ফলে দৈনন্দিন ট্রেন পরিচালনায় তাঁদের মনোযোগ কম। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে