কর্ণফুলী যেন দূষিত না হয় : প্রধানমন্ত্রী

আমি চাই চট্টগ্রামের আরও উন্নতি হোক ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-২ প্রকল্প উদ্বোধন

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৭ মার্চ, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে নদীর তীরবর্তী শিল্প কারখানাগুলোকে নিজস্ব উদ্যোগে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গুসহ কোনো নদী যেন দূষিত না হয়। বিশেষ করে কর্ণফুলী যেন কোনো অবস্থাতেই দূষিত না হয়। সে ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। সাথে অন্য নদীগুলোরও সুরক্ষা দিতে হবে। নদী দূষণ ঠেকাতে কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন অনেক শিল্প কল-কারখানা হচ্ছে। প্রত্যেক শিল্প কারখানায় অবশ্যই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। গতকাল বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-২ প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন আমরা নির্মাণ করছি। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে নির্মাণ করেছি। মীরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, বাঁশখালী-আনোয়ারা ও মহেশখালী ও কক্সবাজারে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। মীরসরাইয়ে দেশের বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। শুধু মীরসরাই শিল্পনগরী নয় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। ইতোমধ্যে কিছু কাজও শুরু করেছি। এতে সুরক্ষাও হবে পাশাপাশি পর্যটন হবে।
চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সত্যিকার অর্থে আমাদের বাণিজ্য নগরী হলো চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি সর্বক্ষেত্রে চট্টগ্রামের বিরাট অবদান রয়েছে। তাই আমি চট্টগ্রামকে সবসময় খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকি। চট্টগ্রামে অনেক অফিসের প্রধান কার্যালয় ছিল। ’৭৫ এর পরের সরকারগুলো সেসব ঢাকায় নিয়ে আসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রাম আবার প্রাণ ফিরে পায়। চট্টগ্রামে প্রথম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আওয়ামী লীগ সরকার করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছোটবেলা থেকে আমরা চট্টগ্রামে যেতাম। বিশেষ করে আমার বাবা যখন জেলের বাইরে থাকতেন, অন্তত প্রতি শীতকালে একবার করে চট্টগ্রাম-কঙবাজার বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সেদিক থেকে চট্টগ্রামের সাথে আমাদের একটা আলাদা সম্পর্ক রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে কাফকো, সিইউএফএল, কোরিয়ান ইপিজেড, আনোয়ারায় চায়না ইকোনমিক জোন এবং বিভিন্ন আবাসিক এলাকার পানির চাহিদা মেটাতে দৈনিক ৬ কোটি লিটার সরবরাহের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের পানির চাহিদা পূরণে বিভিন্ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় পানি নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের অনেক অসুবিধা ছিল। এটা শুধু চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের প্রায় জেলায় এ সমস্যা ছিল। আমরা সরকারে আসার পর থেকে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি এ সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই আমরা চট্টগ্রামের পানির সমস্যা সমাধানে প্রকল্প হাতে নিই। ১৯৯৯ সালে জাইকা কর্ণফুলী নদী থেকে পানি শোধন করে সরবরাহের প্রকল্প গ্রহণ করে এবং সমীক্ষা করে। ২০০১ সালে আমরা সরকারে আসতে পারিনি। তাই কাজটিও সম্পন্ন হয়নি। দ্বিতীয়বার সরকারে আসার পর ২০১১ সালে আবার আমরা উদ্যোগ নিই এবং কাজ শুরু করি। ২০১৭ সালে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প ফেজ-১ চালু করা হয়। এতে চট্টগ্রাম নগরীর পানি সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। তবে স্বাভাবিকভাবে চাহিদা বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে আমরা আরও একটি উদ্যোগ নিই। ২০২০ সালে মদুনাঘাটে ৯ হাজার কোটি লিটার ধারণক্ষমতার শেখ রাসেল পানি শোধনাগার উদ্বোধন করি। আজ কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প দ্বিতীয় ফেজ-এর উদ্বোধন করা হল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার একেবারে তৃণমূলে, ইউনিয়ন পর্যায়ের মানুষের জন্যও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে নয়, বরং ইউনিয়ন পর্যায়ের ৯০ শতাংশ মানুষ যেন বিশুদ্ধ পানি পায়, সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমার অনুরোধ থাকবে, বৃষ্টির পানি যেন সংরক্ষণ করা হয়। যখনই প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই যেন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শুধুমাত্র পানি শোধন করে দেবো, সেটাই ব্যবহার করবেন এমন যেন না হয়। হাউজিং সোসাইটি ও শিল্প কারখানায় জলাধার যেন থাকে। বর্ষার পানি সংরক্ষণে নজর দিতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা কমানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। তাই ভূগর্ভস্থ পানি যেন না কমে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা হয়তো বাইরে থেকে দেখা যায় না, কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি আমাদের ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করতে পারে। আমরা নদীগুলোও ড্রেজিং করছি। যাতে নৌপথ সুরক্ষিত হয় এবং নদীর পানির ধারণক্ষমতা বাড়ে।
চট্টগ্রামে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য প্রকল্প নেয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামে ড্রেনেজ ও স্যানিটেশন মাস্টারপ্ল্যান করেছি। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চট্টগ্রামে পয়ঃনিষ্কাশনের প্রথম পর্যায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আরও পাঁচটি পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার হবে।
কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কর্ণফুলীর নিচে টানেলের কথা আসলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা মনে পড়ে। তিনি এটা সবসময় চেয়েছিলেন। ওনার একটা দাবিও ছিল। এখন কাজ এগিয়ে চলেছে। দুর্ভাগ্য যে তিনি আমাদের মাঝে নেই। উনার সময়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ছিল অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।
চট্টগ্রামে আরও ৫টি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ প্রকল্প দেওয়া হয়েছে এবং সেটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু হয়েছে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প প্রথম পর্যায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম মহানগরীতে আরও ৫টি পয়ঃশোধানাগার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি চাই এতো চমৎকার একটা এলাকার সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষত রেখে যেন এর সার্বিক উন্নয়ন হয়, সেদিকে আপনারা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিবেন। আমি চাই চট্টগ্রামের আরও উন্নতি হোক।
বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শেখ হাসিনা পানি শোধানাগার প্রকল্প-২ এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন, তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ।
অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যা কখনো মানুষ চিন্তাও করেনি তা ওনার কাছ থেকে এসেছে। মীরসরাই ইকোনমিক জোনে অনেক মাদার ইন্ডাস্ট্রি হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে। সেখানে কি ইউটিলিটি সেবা লাগবে তার জন্য একটা কমিপ্রহেনসিভ প্রজেক্ট হবে। এত বড় প্রকল্পে সুপেয় পানির যোগান দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে যদি পানির অসুবিধা হয়, তাহলে মেঘনা নদী থেকে পানি আনতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শুধু মীরসরাইয়ের জন্য না, আরও একশটি ইকোনমিক জোন করা হচ্ছে, সেগুলোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমি কাউকে হার্ড করতে কথাগুলো বলছিনা। মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন মেয়র ছিলেন তখন এই নগরী ডাস্টবিনের নগরী ছিল। তিনি তাঁর কর্মদক্ষতায় আধুনিক নগরীতে পরিণত করেছিলেন। বিশ্বের কাছে আধুনিক-পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন।
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সমসাময়িক দেশ পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি, তাহলে আমরা দেখি অর্থনৈতিক সকল প্যারামিটারে আমরা তাদের চেয়ে এগিয়ে আছি। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪১ সালের আগেই উন্নত বাংলাদেশ হবে। সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এক সময় চট্টগ্রাম নগরীর মানুষকে প্রতিদিন পানির জন্য আন্দোলন করতে হতো। প্রধানমন্ত্রী এই চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের পানির সমস্যা নিরসন করেছেন। চট্টগ্রামবাসী এখন ২৪ ঘন্টা সুপেয় পানি পাচ্ছেন। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তিনি ধন্যবাদ জানান। মেয়র নগরীর আরো ২১ খাল থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং খননের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনি চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য মেগা প্রকল্প দিয়েছেন। এরই প্রকল্পের অধীনে নগরীর ৩৬টি খাল খননের কাজ চলমান রয়েছে। অন্যান্য আরো ২১টি খাল রয়ে গেছে। এগুলো উভয় পাশ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছদ করে খননের ব্যবস্থা না করলে আরও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। এই ব্যাপারে আপনার সহায়তা কামনা করছি।
এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন, সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান, মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম, মেট্রোপলিটন চেম্বার সভাপতি খলিলুর রহমান, ওয়াসার বোর্ড মেম্বর সোলায়মান আলম শেঠ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী সাব্বির ইকবাল, প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটন, মো. গিয়াস উদ্দিন, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, রুমকী সেনগুপ্ত, জেসমিন পারভিন জেসি, আবদুস সালাম মাসুম, চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম প্রমুখ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট কমল ১০%
পরবর্তী নিবন্ধসাগরে লঘুচাপ রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে