কর্ণফুলীতে মিলল স্কুলছাত্রের লাশ, ৪ সহপাঠী গ্রেপ্তার

দেড় মাস আগে বেঞ্চে বসা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল একজনের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার কথা বলে নিয়ে যায় হামিদচরে খুন করার আগে স্কুল ড্রেস খুলে রাখা হয় ব্যাগে

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১ মে, ২০২৫ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

দুই মাস আগে স্কুলের বেঞ্চে বসা নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে সানোয়ারা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রাহাত খানের কথাকাটাকাটি হয়। সেটি মীমাংসাও হয়ে যায়। কিন্তু এই ঘটনার জেরে গত মঙ্গলবার টিফিন ছুটির পর হামিদ চরে ক্রিকেট খেলার মাঠ আছে বলে তাকে নদীর তীরে নিয়ে যায় সহপাঠীরা। সেখানে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তারাই মেরে নদীতে ফেলে দেয় বলে অভিযোগ করেন নিহত রাহাতের পিতা মো. লিয়াকত আলী।

গতকাল বুধবার সকালে ১৭ ঘণ্টা পর নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন হামিদচরের কর্ণফুলী নদী থেকে রাহাত খানের (১২) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত রাহাত চান্দগাঁও থানাধীন সানোয়ারা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। সে চান্দগাঁওয়ের পূর্ব ফরিদার পাড়া এলাকার মো. লিয়াকত আলীর তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। রাহাতের বাবার একটি গ্রিলের ওয়ার্কশপ রয়েছে।

সানোয়ারা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল মনসুর বলেন, মঙ্গলবার সকাল ১১টা পর্যন্ত (টিফিন ছুটির আগ পর্যন্ত) ক্লাসে ছিল রাহাত। টিফিন ছুটিতে সেসহ তার ক্লাসের কয়েকজন বন্ধু স্কুল থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর আর ফিরে আসেনি।

হামিদচরে পাওয়া যায় রাহাতের স্কুল ব্যাগ : স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে স্কুলের একজন শিক্ষক ফোন করে তাকে বলেন, হামিদচরের শাহাজী মাজার সড়কে স্কুলের এক ছাত্রের ব্যাগ, জুতা ও প্যান্ট পাওয়া গেছে। ব্যাগে থাকা বেতন রশিদ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে সহকর্মী ফোন করেছিলেন রাহাতের পরিবারে। ফোন করার পর রাহাতের পরিবারের লোকজন সেখানে গিয়ে জুতা, ব্যাগ নিয়ে আসেন।

স্কুলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে শনাক্ত হয় খুনী সহপাঠীদের : স্কুল ব্যাগ পাওয়ার পর অনেক খোঁজাখুঁজির পরও রাহাতকে না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ স্কুলে থাকা সিসি ক্যামেরা চেক করে দেখে। তাতে দেখা গেছে, এক সহপাঠীর সঙ্গে রাহাত স্কুল থেকে বের হয়েছে। পরে পুলিশ ঐ সহপাঠীকে আটক করে। আটককৃত সহপাঠী আরো তিনজনের নাম পুলিশকে জানায়। তারা সকলেই স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র; রাহাতের একই ক্লাসের।

পুলিশ জানায়, ওই তিন ছাত্রের নামঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের বাসায় গিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা রাহাতকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার এবং তাদের দেখানো মতে কর্ণফুলী থেকে রাহাতের লাশটি উদ্ধার করা হয়।

মাবাবার বড় স্বপ্ন ছিল রাহাতকে নিয়ে : পরিবারের তিন ভাইয়ের মধ্যে রাহাত সবার ছোট। তার বড় দুই ভাই রয়েছে। তবে তারা অসুস্থ। পরিবারে মাবাবার স্বপ্ন ছিল রাহাতকে নিয়ে। মেধাবী ছিল, খেলাধুলায় সেরা ছিল, সেই ছেলেটাই নেই।

বাড়ির উঠানে পড়ে রয়েছে শখের প্রাইভেট কার : রাহাত মাবাবার ছোট সন্তান হিসেবে কোনো শখই অপূরণ রাখেনি। ৭ম শ্রেণির ছাত্র নিজে পরিবারের প্রাইভেট কার ড্রাইভ করত। স্কুল ছুটির পর যেকোনো প্রয়োজনে বা কাজে রাহাত নিজে তার প্রাইভেটকারটি চালাত। গতকাল দুপুরে চান্দগাঁওয়ের পূর্ব ফরিদার পাড়াস্থ রাহাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের চার তলা বিল্ডিংয়ের সামনের উঠানে একটি প্রাইভেট কার ও একটি স্টেশন ওয়াগন পড়ে আছে। এসময় মা রোজি আক্তারের বিলাপ করেতে করতে সেসব কথাই বলছিলেন বারবার।

ওয়াহিদের নেতৃত্বে আমার ছেলেকে মেরে ফেলা হয় : বুক ভরা আর্তনাদ আর বারবার মুর্চ্ছা যাচ্ছিলেন রাহাতের বাবা লিয়াকত আলী। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেড়দুই মাস আগে এক সহপাঠীর সাথে রাহাতের কথা কাটাকাটি হয়েছিল। সম্ভবত বেঞ্চে বসা নিয়ে এ কথা কাটাকাটি। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে তখন রাহাত তার মাকে এ কথা জানায়। কারো সাথে ঝগড়া না করতে তখন তাকে আমরা বলেছিলাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলেকে ওয়াহিদের নেতৃত্বে খুন করা হয়েছে। আমি আমার ছেলে হত্যাকারীদের বিচার চাই, ফাঁসি চাই।

তিনি বলেন, প্রতিদিনের ন্যায় মঙ্গলবার স্কুলে গিয়েছিল রাহাত। কিন্তু যথাসময়ে বাসায় ফিরেনি। এ জন্য তার খোঁজ করার জন্য স্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানে তার খোঁজ পাইনি। পরে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মারফত হামিদচরে রাহাতের ব্যাগ, প্যান্ট, জুতার সন্ধান পাই এবং সেখানে গিয়ে তা সংগ্রহ করি। পাশাপাশি রাহাতকে খোঁজাখুঁজি করি। কিন্তু তার সন্ধান মেলেনি।

সম্ভাব্য সব জায়গায় রাহাতকে খোঁজার কথা জানিয়ে রাহাতের বাবা বলেন, কোথাও ছেলেকে পাইনি। পরে আজকে (গতকাল) সকালে হামিদচরের নদীর চরে তার লাশ পাওয়ার খবর পাই। রাহাতের বাবা আরো বলেন, যে সহপাঠীর সাথে রাহাত স্কুল থেকে বের হয়েছিল, তার সাথে রাহাতের ঝগড়া হয়েছিল। আমাদের ধারণা, ঐ সহপাঠী পরিকল্পনা করে ছেলেকে খুন করেছে।

রাহাতের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তার মা রোজী আক্তার। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, রাহাত বলতআমি এখন বড় হয়ে গেছি না, তোমরা কেন আমাকে স্কুলে দিয়ে আস, আবার আনতেও যাও? ছেলে আমার খেলা পাগল ছিল। খেলার কথা বললে ছুটে যেত। এসব কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন রোজী আক্তার। তিনি বলেন, আমার ছেলেটি এমন শান্ত ছিল। যা বলতাম তাই শুনত। আমাদের স্বপ্ন ছিল ছেলে পড়াশোনা শেষ করে মানুষের মতো মানুষ হবে, ক্রিকেটার হবে এমন স্বপ্নও দেখতাম। ছেলেরও একই রকম স্বপ্ন ছিল। এখন সবকিছু শেষ। আমাদের ছেলে আর আমাদের মাঝে নেই। আমাদের কাছ থেকে তাকে অনেক দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যারা ঘটনায় জড়িত, তাদের বিচার চাই। তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক যা বললেন : আমাদের স্কুলে সকাল ৮টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত স্কুলের ক্লাস হয়। রাহাত এবং গ্রেপ্তার তার সহপাঠীরা মঙ্গলবার সকাল ১১টা টিফিন ছুটির আগ পর্যন্ত ক্লাসে ছিল। টিফিন ছুটিতে তারা স্কুল থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর আর ফিরে আসেনি। তিনি বলেন, এরমধ্যে দুপুর ২টার দিকে রাহাতের মাবাবা স্কুলে এসে ছেলের খোঁজ করেন। আমরা বলেছি, তার তো বাসায় চলে যাওয়ার কথা, বাসায় গিয়ে ভালো করে খোঁজ করুন। স্কুল মাঠসহ আশেপাশে রাহাতকে খোঁজা হয় জানিয়ে শিক্ষক মো. আবুল মনসুর বলেন, রাহাতের মাবাবা স্কুল থেকে চলে যাওয়ার পর বিকেল ৩টার দিকে আমার এক সহকর্মীর কাছে অজ্ঞাত একটা ফোন নম্বর থেকে কল আসে। ফোনে জানানো হয়, হামিদচরের শাহাজী মাজার সড়কে আমাদের স্কুলের এক ছাত্রের ব্যাগ, জুতা ও প্যান্ট পাওয়া গেছে। ব্যাগে থাকা বেতন রশিদ থেকে নম্বর নিয়ে সহকর্মীকে ফোন করা হয়েছিল জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, বিষয়টি রাহাতের পরিবারকে জানানোর পর তারা সেখানে গিয়ে জুতা, ব্যাগ, প্যান্ট নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের স্কুলে থাকা সিসি ক্যামেরা চেক করে দেখেছি। তাতে দেখা গেছে, এক সহপাঠীর সাথে রাহাত স্কুল থেকে বের হয়েছে। পরে পুলিশ ঐ সহপাঠীকে আটক করে। জানতে পেরেছি, আটককৃত সহপাঠী আরো তিনজনের নাম বলেছে। তারা সকলেই আমাদের স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। পুলিশ ফের স্কুলে আসার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ উক্ত তিন ছাত্রের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করেছে এবং তাদের বাসায় গিয়েছে। জানতে পেরেছি, পুলিশ এ তিনজনকেও থানায় নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমাদের স্কুল থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। স্কুলের তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর জোন) আমিরুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, শিশু রাহাতের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে। আমাদের তদন্ত কাজ চলছে। হত্যার ক্লু বের করার চেষ্টা করছি। হত্যা মিশনে কতজন ছিল, কারা ঘটনায় জড়িত, আমরা তা বের করার চেষ্টা করছি। এখন স্পষ্ট করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। পরে বিস্তারিত জানা যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপড়ে আছে ট্রফি-মেডেল নেই শুধু রাহাত
পরবর্তী নিবন্ধহাই কোর্টে চিন্ময় দাসের জামিন, স্থগিতের আবেদন রাষ্ট্রপক্ষের