করোনা ১৯ প্রতিরোধে জনসমষ্টির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে মার্চ ২০২১ থেকে। ভ্যাকসিন কার্যক্রমকে সূচারু বিধিবদ্ধভাবে সম্পন্ন করার জন্য অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ভ্যাকসিনকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত ও কম্পিঊটার সফ্টওয়ার দিয়ে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ তার অন্যতম। পর্যায় গুলো ছিল : প্রথমে ওয়েব সাইটে এনআইডি কার্ড নিশ্চিত করে কেন্দ্র ভিত্তিক রেজিস্ট্রেশন করে ভেকসিন কার্ড ডাউনলোড করে প্রিন্টাউট, এসএমএস দ্বারা প্রথম ডোজ দেয়ার তারিখ নির্ধারণ করে কেন্দ্রে ভেকসিন নিতে কার্ড সহ যাওয়ার নির্দেশ, কেন্দ্রে কার্ডে প্রথম ডোজ দেয়ার তারিখ লিখে অন্য অংশে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার তারিখ লিখে দেয়া, ভেকসিন দেয়া, অতপর দ্বিতীয় ডোজের তারিখের এসএমএস নির্দেশ পাওয়ার পর ভেকসিন কার্ডের নিজ অংশের ফটোকপি সহ কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ফটোকপি প্রদান ও ভ্যাকসিন কার্ডে দ্বিতীয় ডোজের তারিখ লিখে দেয়ার পর ভ্যাকসিন নেয়া, ও, ওয়েব সাইট থেকে ভ্যাকসিন সনদ ডাউনলোড করা।
এসব হলো নির্দেশিত তাত্ত্বিক ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবে তার প্রচুর ব্যত্যয় ঘটেছে এবং অনেকে মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। অনেকে এসএমএস পাননি। পরে বলা হল এসএমএসের প্রয়োজন নেই। এনআইডি ও ভ্যাকসিন কার্ড নিয়ে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে গেলেই হবে। ফলে কেন্দ্র সমূহে প্রচণ্ড ভিড় ও স্বাস্থ্য বিধি লংঘিত হয়। প্রথমে নির্ধারিত ছিল প্রথম ডোজের চার সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ। পরবর্তীতে সেটা আট সপ্তাহ করা হয়। দ্বিতীয় ডোজের এসএমএস বেশীর ভাগ মানুষ পাননি। যখন বিজ্ঞপিত হলো এসএমএস না হলেও চলবে তখন প্রথম ডোজের পুনরাবৃত্তি হলো। তারপর ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ডাউনলোড করতে সাইটে যখন লগ করা হলো তখন বেশীর ভাগের উত্তর আসলো দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়নি। অনেকগুলো গবেষণার ডেটা মেনেজারের দায়িত্বে থাকার অভিজ্ঞতা পুরো ব্যাপার নিয়ে পরিজ্ঞান ও সমীক্ষায় উদ্যমিত করে। আমার কাছে কোন এসএমএস আসেনি। চট্টগ্রামে ভেকসিন দেয়ার দ্বিতীয় দিনে ০৮/০২/২১ তারিখ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কেন্দ্রে আমি প্রথম ডোজ নেই। কার্ডে আমার দ্বিতীয় ডোজ দেবার তারিখ দেয়া হয় ১১/০৩/২১, তখনকার নির্দেশনায় চার সপ্তাহ পর। পরবর্তীতে তা আট সপ্তাহ পরে নির্দেশিত হয়। আমি এসএমএস না পেয়েও নয় সপ্তাহ পর ১৩/০৪/২০২১ তারিখে একই কেন্দ্রে দ্বিতীয় ডোজ নেই, ভ্যাকসিন কার্ডের কপি জমা দেই ও কার্ডের নিজ অংশে তারিখ ও স্বাক্ষর লিখা হয়। এসএমএস না আসা ও ভিড় ও স্বাস্থ্য বিধি লংঘন ছাড়া সবকিছু মোটামুটি ঠিকই মনে হলো।
ঝামেলা শুরু হলো যখন সাইট থেকে ভ্যাকসিন সনদ ডাউনলোড করতে যাওয়া হলো। সাইট বলছিল দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়নি। তখন মনে পড়লো আমাদের বহুল প্রচলিত প্রবাদ, ‘কাজীর গরু খাতায় থাকে গোয়ালে থাকে না’। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করতে গিয়ে কোন কিছুই যখন করা যাচ্ছিল না তখন ২৮/০৪/২১ তারিখ রাতে ফেসবুকে সমস্যা ও কারণ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে একটা পোস্ট দেই। কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আমাদের একজন স্নাতকোত্তর ছাত্রী যোগাযোগ করে আমার কিছু তথ্য নেয়। তার কিছুক্ষণ পর আমি এসএমএস পাই যে আমার দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন হয়েছে ও সাইট থেকে ভেকসিন সনদ সংগ্রহ করার জন্য।
ভেকসিন সনদ সংগ্রহ করার পর দেখা গেল ভ্যাকসিন কার্ড ও সনদের মধ্যে ভ্যাকসিন দেয়ার তারিখ দুটির গড়মিল। প্রথম ডোজ ০৮/০২/২১ তারিখে দেয়া হলেও সনদে আছে ০১/০৩/২১ এবং দ্বিতীয় ডোজ ১৩/০৪/২১ তারিখে দেয়া হলেও সনদে আছে ২৮/০৫/২১। আমাদের ছাত্রী আমার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার পর সেদিনই। তারিখের এই গড়মিল আমার ধারণাকে নিশ্চিত করে। ধারণাগুলো হলো। ১. সফ্টওয়ার যারা প্রণয়ন করেছে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জনমানসিকতা এবং কর্মধারা সম্পর্কে ধারণা অপ্রতুল ছিল। তারা ডাটা এন্ট্রির তারিখকে লক করে দেয়ায় যেদিন ডাটা এন্ট্রি করা হয়েছে সেদিনই ভ্যাকসিন দেয়ার তারিখ হয়ে গেছে। আমার ব্যাপারে ডোজ দুটির তথ্য যেদিন ঢুকানো হয়েছে সেদিনের তারিখ। সফ্টওয়ারে মাঠ পর্য়ায়ের অভিজ্ঞতার অভাবে যথাযথ উপযোগীকরণ করে প্রণয়ন করা হয়নি। এর ফলাফল দ্বিতীয় ডোজের তারিখ পিছিয়ে যাওয়া, এসএমএস না পাওয়া সহ অন্যান্য সমস্যা সমূহ। ২. ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের সম্পূর্ণ কার্যক্রম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট এসওপি (স্টেনডার্ড অপারেশন প্রসিজিওর) দ্বারা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি এবং তার গুরুত্ব ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। ৩. মনিটরিং ও ইভেলুয়েশন, ডেটা চেক ইত্যাদি যথাযথ ভাবে করা হয়নি। ৩. যেকোন ডেটাবেজে প্রথম হাতে লিখা ফরমকে সোর্স ডকুমেন্ট বলা এবং তাকে নিশ্চিত ধরা হয়। পরবর্তী রেজিষ্টার বা কম্পিটারে নেয়া ডেটাকে ট্রান্সক্রাইভড ডেটা বলা হয়। এটা বৈজ্ঞানিক ভাব স্বীকৃত সোর্স ডেটার সাথে ট্রান্সক্রাইভড ডেটার প্রায় দশ শতাংশ গড়মিল হয়। সেজন্য রেনডমলি সোর্স আর ট্রান্সক্রাইভড ডেটা নিয়মিত মিলাতে ও খাপ খাওয়াতে হয়। ৪. সোর্স আর ট্রান্সক্রাইভড ডেটার গড়মিল ভবিষ্যতে আইনগত সহ অনেক সমস্যার উদ্ভব ঘটাতে পারে। এই গড়মিল সমস্যা সমাধানে কিছু ডেমেজ কন্ট্রোল আপডেটিং করতে হবে। যা হলো। ১. সফ্টওয়ার এডিট করতে হবে। কয়েকটি ফিল্ড দিয়ে। ক) প্রথম ডোজ তারিখ খ) প্রথম ডোজ এন্ট্রি তারিখ গ) প্রথম ডোজ কেন্দ্র ঘ) প্রখম ডোজ ডাটাএন্ট্রিকারীর কোড ঙ) দ্বিতীয় ডোজের নির্ধারিত তারিখ চ) দ্বিতীয় ডোজ তারিখ ছ) দ্বিতীয় ডোজ এন্ট্রি তারিখ জ) দ্বিতীয় ডোজ কেন্দ্র ঝ) দ্বিতীয় ডোজ ডাটা এন্ট্রিকারীর কোড। খ ও ছ ফিল্ড হবে নন এডিটেবল অটো যেদিন ডেটা এন্ট্রি হবে সেদিন। ঙ ফিল্ড হবে কেলকুলেটেড প্রথম ডোজ নেয়ার তারিখ থেকে আট সপ্তাহ বা ছাপান্ন দিন পরের তারিখ। ঙ ও ছ ফিল্ডের সাথে যথাক্রমে দ্বিতীয় ডোজ ও সনদ নেয়ার এসএমএস এর সংযোগ দিতে হবে। ২. ব্যাপকভিত্তিক যথাযথ এসওপি প্রণয়ন করে কার্যকরী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ৩. ডেটামেনেজমেন্টের জন্য পুরোপুরি টীম, ডেটামেনেজার, মনিটরিং ইভেলুয়েশন, রিকনসাইলিং ইত্যাদি কাজ গুলো করতে হবে।
কোভিডকে নিয়ে আমাদের টিকে থাকতে হবে। ভ্যাকসিন হলো তার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বর্ম্য যা হয়ত চলতেই থাকবে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ভ্রমণ, গবেষণা, আইনগত ও অন্যান্য অনেক কিছুর জন্য ভ্যাকসিনের সঠিক তথ্য সম্বলিত সনদ ও জাতীয় ডেটাবেজ অত্যাবশকীয়। তাই এ ব্যাপারে সবার সক্রিয় হতে হবে। [ প্রেক্ষিত : দৈনিক আজাদীতে ৪ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদন ]
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক