এই পরিস্থিতি যে তৈরি হবে তা অনুমেয় ছিল। চীনের উহান প্রদেশে সৃষ্ট এক অণু করোনা জীবাণু, মাত্র ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান জলে যার আয়ুনাশ, তা কিনা পুরো পৃথিবীকে প্রলয়-নৃত্য দেখিয়ে দিল। তবুও অতিমারি বিশ্বে ‘সোনার জীয়নকাঠি’ হিসাবে প্রতিষেধক টিকা তৈরিতে যারপরনাই মেধা-পরিশ্রমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন পৃথিবীশ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। মারাত্মক সংক্রামক রোগের নিদানে একটা নিরাপদ ও কার্যকর টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগের স্তর খুঁজে পেতে কমপক্ষে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। সেখানে বিশাল মৃত্যুবাণ হয়ে আসা করোনা করাল গ্রাসে জর্জরিত পৃথিবীকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ‘করোনা প্রতিরোধক ভ্যাকসিন’ উপহার দিলেন এই মহামানবেরা।
কিন্তু মানব কল্যাণের যে ব্রত নিয়ে বিজ্ঞানী আকুল থাকেন, তার প্রায়োগিক দিক্-দিগন্ত শেষপর্যন্ত তাঁদের হাতে থাকে না। করোনা যুদ্ধে ঝরে গেল কত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও মহৎপ্রাণ। করোনার দুঃসহ ঢেউ এখনো বিভীষিকার মতো আছড়ে পড়ছে। করোনা টিকা আবিষ্কার সব সম্মুখসারির যোদ্ধাদের ও অতি ঝুঁকিতে থাকা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর জন্য সুসংবাদ বয়ে আনতে পারতো।
ফাইজার, মডার্না, অঙফোর্ড ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশে টিকা করণের অনুমোদন পেয়েছে। সহসা করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তি সত্যিকার অর্থে এক বড়মাপের হাতিয়ার যা করোনা মোকাবিলায় সাহায্য করবে। মূলত করোনা জীবাণুমুক্ত দেশ ও বিশ্ব ফিরে পাওয়ার পথ তিনটা-
এক. করোনাভাইরাস যদি আপনা আপনি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
দুই. কোন অঞ্চলের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী সংক্রমিত হয়ে কম্যুনিটিতে রোগ প্রতিরোধক হার্ড ইমিউনিটি তৈরি। তবে এক্ষেত্রে বিপুল প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকে।
তিন. নিদেনপক্ষে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জনগণকে টিকাকরণের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধক হার্ড ইমিউনিটি তৈরি।
সুতরাং দ্রুততার সাথে টিকাকরণ হলো সর্বোত্তম পন্থা। যুক্তরাষ্ট্র সহ পুরো ইউরোপ আবারো করোনা ঢেউয়ের কবলে পড়েছে। অধিক সংক্রামক শক্তির নতুন ‘করোনা স্ট্রেইন’ নতুন নিশানা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ার হুমকি জারি করেছে। এই কারণে উন্নত দেশগুলো হাতে পাওয়া ‘করোনা ভ্যাকসিন’ যত বেশি সংখ্যক সম্ভব যোগাড় করে নিজ নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যস্ত।
কানাডা বর্তমানে নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাঁচ-ছয়গুণ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার পরিকল্পনায অটুট। এভাবে নিজ চাহিদার বেশ কয়েকগুণ টিকা হাতে নিতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য-সহ উন্নত বিশ্ব। তাতে উন্নয়নশীল দেশসমূহের ‘করোনা টিকা’ প্রাপ্তি সংকট ঘনীভূত হবে বৈকি। বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা- ‘হু’ সহ পৃথিবীর অনেক নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব করোনা টিকা বিতরণে ‘সাম্য নীতি’ প্রণয়নের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু তা অধরা থেকে যাবে মনে হয়।
বিশেষজ্ঞ মত এই- করোনা জীবাণুর সংক্রমণ এত তাড়াতাড়ি থেমে যাবে না। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মহামারি বেশ কয়েক বছর স্থায়ী হয়েছিল। ইনফ্লুয়েঞ্জা, বার্ড ফ্লু’র অস্থিত্ব লোপ পায়নি। অতিমারি থেমে গেলেও বছর বছর করোনা টিকা নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। যদিও বিশ্বব্যাপী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা শতাধিক ধরনের করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আসার সম্ভাবনা, তবুও নিজ দেশের চাহিদা মেটাতে করোনা টিকা প্রাপ্তির সকল দুয়ার উন্মুক্ত রাখা দরকার।
চুক্তি মোতাবেক অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেও অতি ঘনবসতির বাংলাদেশে দ্রুত টিকাকরণের জন্য বিকল্প উৎস বেছে নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ খোলার আগে শিক্ষক এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক বয়স্ক ব্যক্তিদের টিকাকরণের প্রকল্প গ্রহণ, যে সুপারিশ অনেক দেশ বিবেচনায় নিচ্ছে। সকল দিক বিবেচনায় যেসব পদক্ষেপ উত্তম হতে পারে-
এক. গ্লোব বায়োটেকের ‘বঙ্গভ্যাঙ ভ্যাকসিন ’ উৎপাদনে তরিৎ সকল সহায়তা প্রদান। এবং ভ্যাকসিন’ উৎপাদনে সক্ষম আরো কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানকে এই ব্যাপারে উৎসাহিত করা। প্রসংগত উল্লেখ্য চীন, রাশিয়া, ভারত নিজ নিজ দেশীয় করোনা টিকা নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পূর্ণ করার পথ বেছে নিয়েছে।
দুই. বিশ্বে যেসব করোনা টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পূর্ণ করার পথে অগ্রসরমান অবস্থায় আছে, তাদের সাথে বাংলাদেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণ। এতে করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন কোনটা নিরূপণ করা যাবে। সাথে সেই টিকা প্রাপ্তির সহজলভ্যতা সাধন হবে। অন্তত এতে করে দেশকে করোনা-কালে বিশ্বে দুর্ভিক্ষকালীন চাল সংগ্রহের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শীতায় বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় সামগ্রিক সফলতার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে বিশ্বপটে চিহ্নিত হয়েছে। দ্রুততম সময়ে করোনা টিকাপ্রাপ্তি ও টিকাকরণের যাবতীয় কর্ম সম্পাদনও তাঁর সুনিপুণ নেতৃত্বে সম্ভব হবে-এই সোনালি প্রত্যাশা সকলের।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল