করোনা ও সামাজিক বন্ধন

আয়েশা পারভীন চৌধুরী | শুক্রবার , ১ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

মন ছুটে যায় আপনের কাছে। বিশ্ব আজ স্তব্ধ। নীরব। ভাইরাস করোনা পুরো বিশ্বকে এক সূত্রে নিয়ে এসেছে। নিজেকে নিয়েই প্রায় সবাই ব্যস্ত ছিল। যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা সবাইকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। আর্থিক সমস্যা ও অন্যান্য কারণে বিশেষ দিনে ও বিশেষ ব্যক্তিকে ঘিরে আনন্দ আয়োজনের ব্যবস্থা থাকলেও সকলের জন্য সেই আনন্দ আয়োজন ছিল না। এভাবেই আমাদের সামাজিক বন্ধনগুলো দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছিল। আর করোনার প্রভাবে এখন আমাদের পারিবারিক জীবন ব্যবস্থা একেবারে ঠুণকোতে পরিণত হয়েছে। সব মায়ার বন্ধন ছিঁড়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এখন মারাত্মক হুমকির মধ্যে। এই সময় করোনা থেকে বিপদ মুক্ত হতে মানুষ চার দেওয়ালের মধ্যেও নিরাপদ নয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে প্রায় সবাই অসামাজিক হয়ে পড়েছে। চার দেওয়ালের ভিতরের পারিবারিক বন্ধনটুকুও এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন এখন খুব কাছে থেকেও দূরত্ব বজায় রাখছে। এমন এক সময় যাচ্ছে যেন একজন আর একজন থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে এই যাত্রায় বেঁচে যাবে। যতই রক্তের সম্পর্ক হোক, আত্মার সম্পর্ক হোক আর মানবিক সম্পর্ক হোক সব সম্পর্কগুলো এখন আতঙ্কগ্রস্ত। নিজেকে বাঁচানোর লড়াইয়ে সব সম্পর্কগুলো এখন বিলুপ্ত। একই সূত্রে গাঁথা গভীর মায়া-মমতার বন্ধনগুলো এখন একটি আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। করোনা আতঙ্ক মানুষের মাঝে সকল ধরনের মনুষ্যত্বকেও বিলুপ্ত করছে। স্বার্থপরতার চরম সত্য হচ্ছে করোনার ভয়ে অনেকেই একেবারে আপনজনের মৃত্যুতেও ছুটে যায়নি। সবাইকে অনেক দূরের মানুষে পরিণত করেছে। কাউকে বাসায় ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো বাসায় যায়নি। গেলেও দরজার বাহির থেকে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে বিদায় নেয়। খুব খুব কাছের মানুষগুলোকে এভাবে অনেকেই বিদায় দেন। সৌজন্যতার খাতিরে ঘরে ঢোকার আহ্বান করলেও অন্তরে ছিল করোনা ভাইরাসের ভয়। তাই রাস্তা-ঘাটে-অফিস পাড়ায় দেখা হলেও দূরত্ব বজায় রেখে মত বিনিময় ও সুখ-দুঃখের কথাগুলো বিনিময় করে।
মা-বাবা-ভাই-বোন সবাই যে যার যার ঘরে অবস্থান করে। রোগ-শোক-বিপদ-আপদ, আনন্দ-বেদনায় কেউ সরাসরি আর কারো কাছে ছুটে যায় না। সব খবরা-খবর নেওয়া হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। আপন পর চেনা-জানা-দেখা-অদেখা মানুষের মৃত্যু সংবাদ পড়তে পড়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিকে শোকবার্তার বাহন মনে হয়।। ফোন বেজে উঠলেই ভয় পেয়ে যায়। করোনার ভয়াবহতা যখন চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখন আমাদের প্রবাসী ভাই বোনরা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে দেশে ফিরে। বিশেষ করে ইতালী, স্পেন, ইংল্যান্ড, চিন, ইত্যাদি দেশের প্রবাসীরা দলে দলে এদেশে ফিরতে থাকে। কিন্তু সঠিক নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এই প্রবাসীরা যে যার জায়গায় অবস্থান করতে থাকে। ফলে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটতে থাকে। এমনকি জেনে শুনে অনেক প্রবাসী করোনা উপসর্গ লুকাতে থাকে। আমরা স্বীকার করি এই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আমাদের জন্য বিরাট সম্পদ। আমাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই রেমিটেন্সের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মৃত্যুঘাতি করোনা ভাইরাস নিয়ে ছুটাছুটির ফলে এই রোগ দ্রুত ছড়াতে থাকে। তাছাড়া শত প্রচার-প্রচারনায়ও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনাগ্রহ ছিল। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষরা জীবন ও জীবিকার জন্য ঘর থেকে প্রতিনিয়ত বের হয়েছে। যদিও তাদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সাহায্য ও অনুদানের ব্যবস্থা আছে তবুও তার পরিমাণ ছিল নগণ্য। বিশাল এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সুন্দর ও সঠিক নিয়মে ত্রাণ বিতরণে অনেক অনিয়ম ছিল। এখানে উল্লেখ করতে হয়, সরকারের বরাদ্দকৃত অনুদান ও সাহায্যের অধিকাংশ চেয়ারম্যান, মেম্বার, ওয়ার্ড কমিশনার ও অন্যান্যদের কাছে চলে যায়। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, বস্তায় বস্তায় চাউল, আলু, ডাল ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্যগুলো তাদের আড়তে পাওয়া যায়। মানবিক দিক বিবেচনায় অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাতে সাধারণ দরিদ্রদের অনেকেই উপকৃত হন। সারা বিশ্বে এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত চলছে। এই অবস্থায় আমাদের সমাজের কিছু কিছু মানুষ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল, পর্যটন এলাকা ও আত্নীয়স্বজনের বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যারা জীবন ও জীবিকার জন্য রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ভয় নয়, সচেতনতার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণকে আমাদের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। মানুষ সব কিছু নিজের মত করে নিতে অভ্যস্ত। জীবন বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানায় শ্রেয়।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার বার জনগণকে আশ্বস্ত করেন পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ না হলেও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নেই ,তবে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি করে ফেলে রাখতে নিষেধ করেন। মূলত মানুষের স্বার্থপরতা মানুষকে অমানবিক ও লোভী করে তোলে। ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর প্রথম করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিশ্ব অবগত হয়। প্রথম দিকে তেমন কেউ পাত্তা দেয়নি। নিরবচ্ছিন্ন এক জীবনের হতাশা ও দুর্ভিক্ষের আতঙ্কে সবাই খাদ্য দ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্য পণ্যগুলো মজুদ করতে থাকে। মানুষের মাঝে বিরাজমান মানবিক গুণাবলীগুলো লোপ পেতে থাকে। দোকান-পাট, শপিং মল, বাজারে-প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দিন দিন উধাও হতে শুরু করে। বিশেষ বিশেষ খাদ্য দ্রব্যের সংকট দেখা যায়। যে যার সামর্থ অনুযায়ী মজুদ করতে থাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।ফলে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোরও অভাব দেখা যায়। করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার জন্য সাবান, লিকুইট সোপ ও সেনিটাইজারের মত জিনিসগুলোর সংকট দেখা যায়। মজুদ করার মানসিকতার সাথে সাথে কতিপয় লোভী ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধি করে মানুষের দূর্ভোগ বৃদ্ধি করে। আত্মকেন্দ্রিক মন-মানসিকতায় এই মাসগুলো অতিবাহিত হয় আমাদের দুই পবিত্র ঈদ উৎসব। এই ধরনের ঈদ উৎসবেও আমাদের মাঝে একাকীত্ব ছিল। জীবনে প্রথম এ ধরনের ঈদ পালন করা হয়। অনেকে আত্মীয় ও আপনজন হারিয়েছে। এখনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। তবু আশায় থাকি সোনালী দিনের। আপেক্ষায় থাকি করোনামুক্ত বিশ্বের। আবার নতুন করে আপন পর সবাইকে নিয়ে একটি হতাশামুক্ত, মানবিক ও আনন্দদায়ক বিশ্ব গড়ব বলে।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা